নগরীতে মাদকাসক্তের ৭০ শতাংশই শিক্ষার্থী

# ধরাবাধা অভিযানেই সীমাবদ্ধ কর্তৃপক্ষ #
* আসক্তদের বেশিরভাগের বয়স ১৪-২২ বছর
* সরকারি হিসেবের বাইরে মাদকাসক্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক
কামাল মোস্তফা ঃ মাদকের ভয়াল থাবায় আক্রান্ত খুলনা মহানগরী। যার প্রধান শিকার স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীরা। এ সংখ্যা চরম উদ্বেগের। মাদক নিরাময় কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী আসক্তদের ৭০ শতাংশই বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী। যাদের বয়স ১৪-২২ বছরের ভিতর। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারার অভিযোগ সাধারণের।
সূত্রমতে, খুলনা মহানগরীতে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদিত দশটি মাদক নিরাময় ও পূর্নবাসন কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে গেল অক্টোবর মাসে রোগি ভর্তি ছিল ১০৮ জন। যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী। অক্টোবর মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে ১৬৪ টি, মামলা হয়েছে ৪৩ টি। এসব মামলায় মোট আসামী আটক হয়েছে ৪৭ জন। এর মধ্যে মাদক সিন্ডিকেটের হোতা নগরীর চানমারী এলাকার প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী সজিবকে আটক করা হয়েছে।
এসব মাদকবিরোধী অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ১৭৭২ পিচ ইয়াবা, ৬ কেজি গাঁজা, ১৮০ বোতল ফেনসিডিল, ১ গ্রাম আইস, ৪ লিটার বিলাতি মদ,৩৪ টি মোবাইল সহ নগদ ২ লক্ষ ২৩ হাজার টাকা।
সাধারণ মানুষের অভিযোগ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব শুধু সংখ্যা মাত্র। বাস্তবে মাদকাসক্তের চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। কর্তৃপক্ষের মাদক বিরোধী অভিযানগুলো নিতান্তই দ্বায়সারা। তারা মূলত ছোটোখাটো চুনোপুটি ধরেই দায়িত্ব শেষ করেন। নগরীতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে এমন ব্যক্তিরা মূলত ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। তাদের ধরার ক্ষমতা প্রশাসনের আছে কিনা সন্দেহ। আটক করে আদালতে প্রেরণ করা হলেও কয়েকদিন যেতে না যেতেই জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের পূর্বের আশ্রয় দাতাদের দ্বারা সক্রীয় হয়ে লিপ্ত হয় মাদক কেনাবেচায়। প্রকৃত পক্ষে আইনের ধরাছোঁয়ার বাহিরে থাকা প্রকৃত মাদক যোগান দাতারা অভিনব পন্থায়, সুকৌশলে খুলনার অধিকাংশ এলাকায় মাদকের অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রধান টার্গেট কাস্টমার স্কুল কলেজে পড়–য়া শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নগরীর গল্লামারী সংলগ্ন লায়ন্স স্কুলের কয়েক গজের ভিতরই দুটি বিড়ি-সিগারেটের দোকান। স্কুল ছুটির পর কয়েকজন শিক্ষার্থী লুকিয়ে ধুমপান করছে। এ ছাড়া ময়লাপেতা মোড়ে অবস্থিত আহসানউল্লাহ কলেজ সহ নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশেপাশে এমন বিড়ি সিগারেটের দোকান রয়েছে। নব নির্মিত মোহাম্মদপুর রেল স্টেশনের ওভার ব্রীজের ওপর স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীদের দেখা যায় মাদক সেবনে। নগরীর নিউপথ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে ভর্তি হওয়া মোট রোগির সংখ্যা ৩০ জন, যার ২২ জনই নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। চিকিৎসা নেয়া শিক্ষার্থীদের বয়স ১৪-২৫ বছরের ভিতর। প্রতিদিনই অন্তত ২-৪ জন ভর্তি হচ্ছে। এ নগরীর ছাড়া খানজাহান আলী রোডে অবস্থিত প্রগতি মানসিক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি রোগি ১৪ জন, যার ভিতর শিক্ষার্থী ৭ জন। মুনড্রপস মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছে ১২ জন, যার মধ্যে শিক্ষার্থী ৮ জন। এন এ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ১৮ জন, যার ১০ জনই শিক্ষার্থী। শামসুর রহমান রোডে অবস্থিত কথা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ১৫ জন যার মধ্যে ১০ জন শিক্ষার্থী।
নিউপথ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের নির্বাহি পরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, এখানে ভর্তি হওয়া রোগিদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করি মাদকাসক্তদের সুস্থ করে তুলতে। অনেকেই সুস্থ হয়ে চলে যায়, অনেকে আবার জড়িয়ে পড়ে মাদকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোগি জানান, আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াকালিন মাদকে আসক্ত হই। সেখান থেকে এই পথে দীর্ঘ ২০-২৫ বছর। এখন আমার বয়স ৪০ বছর। গত চার বছর যাবৎ আমি নিউপথ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছি। এখন অনেকটা সুস্থ, পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারিনি। সাময়িক আনন্দ পেলেও এ পথে এসে আমি সব কিছুই হারিয়েছি। স¦াভাবিক জীবনে ফিরতে পারছি না। আমার বন্ধুরা বিয়ে শাদি করে সংসার করছে কিন্তু আমার সংসার হয়নি। এই বয়সে পৌঁছে এখন চাকুরি বা কোন কাজের সংস্থান করতে পারছি না। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমার সামনে। কি করবো জানিনা।
নগরীর নিরালা মোড়ে অবস্থিত উদয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানের রোগি ভর্তির অনুমোদন আছে ১০ জন কিন্তু রোগি ভর্তি রয়েছে ১৩ জন। যার মধ্যে ২ জন শিক্ষার্থী। একজন অনার্স পড়–য়া অন্যজন একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। জানা যায়, অক্টোবর মাসে রোগি ছিল ১৫ জন যার ১২ জনই শিক্ষার্থী। নিরালা এলাকার বাসিন্দা শামীম হোসেন বলেন, শহরে মাদকের ছড়াছড়ি। ইচ্ছা করলেই হাতের নাগালেই পাওয়া যাবে মাদক দ্রব্যাদি। ছেলেরা স্কুলে পড়ে, সারাক্ষণ ভীতিতে থাকি, না জানি সঙ্গ দোষে মরণ নেশা মাদকে আবার কখন জড়িয়ে পড়ে। তাই সব সময় নজর দারিতে রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু সেটা কতক্ষণ। খুলনা সরকারি ব্রজলাল বিশ^বিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক জয়দেব দত্ত বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়। প্রথমে এরা বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে পড়ে আবেগের বশে বা সাময়িক আনন্দ পেতে সিরাগেট ধরে। সেখান থেকেই বাকি মাদকে আসক্ত হয়। পরিবারের অভিভাবকদের এ ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে এ মরণ নেশা থেকে তাদের দূরে রাখতে। পাশাপাশি প্রশাসনকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, জনবল সংকটের দরুণ মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। তার উপর সংকট রয়েছে অভিযান পরিচালনার জন্য যানবাহনের। মাত্র একটি গাড়ি নিয়ে অভিযানসহ অফিসের সব ধরণের কাজ চালাতে হয়। এতাদিন আমাদের অস্ত্রের অনুমোদন ছিল না, সম্প্রতি সেটা আমরা পেয়েছি। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মাদক থেকে দূরে রাখতে আমরা খুলনার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা মূলক ক্যাম্পেইন করি। অভিভাবকদেও তাঁদের ছেলে মেয়েদের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতে উৎসাহিত করি।