তেল মর্দন করতেই খুলনা কলেজের নাম ‘জয়বাংলা’!
খুলনা সরকারি কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট থেকে যেভাবে হয় ‘জয়বাংলা’
মূলহোতা ছিলেন অধ্যক্ষ আমীর হোসেন
ফ্যাসিবাদী নাম নিয়ে বিড়ম্বনায় কর্তৃপক্ষ
পরিবর্তন চান শিক্ষক, শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান ও এম এ আজিম : দলীয়করণ, তেলবাজী এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতেই খুলনায় একটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয় ‘জয়বাংলা’। যা একটি রাজনৈতিক দলের শ্লোগানমাত্র। দলীয় শ্লোগানে নামকরণের এ কাহিনী খুলনা সরকারি ‘জয়বাংলা’ কলেজের। যার পূর্ব নাম ‘খুলনা সরকারি কলেজ’, মূল নাম ‘খুলনা সরকারি কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট।’ নিজেকে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে পরিচিতি ঘটিয়ে সুবিধা লুফে নিতেই কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে, নামকরণের প্রস্তাবে ‘জটিলতা ও বিড়ম্বনার’র ঠুনকো অজুহাত তুলে ধরা হয়।
এদিকে, ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পর এখন এই ‘জয়বাংলা’ নাম নিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধুমাত্র নামের কারণেই সবখানেই একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে কোন অর্থরিটিই এই নামটি মুখে উচ্চারণ করতে চাচ্ছেন না। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এখন রাজনৈতিক এই নামের পরিবর্তন দাবি করেছেন। এ বিষয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের কথাও জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অধ্যক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কারিগরি ও ব্যবসায় শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে খুলনা শহরের প্রাণকেন্দ্র সোনাডাঙ্গায় (আল-ফারুক সোসাইটি সংলগ্ন) ১৯৬৮ সালে খুলনা সরকারি কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট নামে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। তবে, দিন বদলের সাথে সাথে সাধারণ শিক্ষার চাহিদা সম্প্রাসারিত হওয়া এবং সনাতন ধাঁচের কারিগরি শিক্ষার (টাইপিং, শর্টহ্যান্ড ইত্যাদি) গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ায় বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে শিক্ষামন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ১২ মে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ‘খুলনা সরকারি কলেজ’ নামকরণ করে। তারপর থেকে এখানে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়। টানা তিন বছর বেশ চলছিল। কিন্তু কলেজটিতে প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেই নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের তেলমর্দনের পরিকল্পনা করেন। কয়েক মাসের ব্যবধানেই সফল হন তিনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করে ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জয়বাংলা কলেজ হিসেবে নামকরণ করাতে সক্ষম হন তিনি।
অধ্যক্ষ মোল্লা আমীর হোসেন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি পত্র ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর প্রেরণ করা হয়। ওই পত্রে তিনি নগরীর অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ পূর্বক এই কলেজটির নাম ‘খুলনা সরকারি কলেজ, খুলনা’ হওয়ায় নানা জটিলতা ও বিড়ম্বনা সৃস্টি হয় বলে দাবি করে কয়েকটি ‘ঠুনকো’ অজুহাত তুলে ধরে নাম সাদৃশ্যের কারণে প্রায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। সে সুবাদে কলেজের শিক্ষক পরিষদের এক সভার সূত্র উল্লেখ করে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান ‘জয়বাংলা’ স্মরণে ‘সরকারি জয়বাংলা কলেজ, খুলনা’ নামকরণের প্রস্তাব প্রেরণ করেন। একই সঙ্গে ‘খুলনা সরকারি কলেজ, খুলনা’র নাম পরিবর্তন করে ‘সরকারি জয়বাংলা কলেজ, খুলনা’ নামকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠানটি একটি রাজনৈতিক দলের শ্লোগানে ‘জয়বাংলা’ নাম ধারণ করে। যদিও বিনিময় পুরস্কার হিসেবে তৎকালীন অধ্যক্ষ মোল্লা আমীর হোসেনকে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদে বসানো হয়। তিনি এ কলেজ থেকে ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি বিদায় নেন।
এদিকে, প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে দক্ষ শিক্ষকমন্ডলীর দ্বারা শ্রেণি কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। কিন্তু মোল্লা আমীর হোসেনের প্রস্তাবকৃত নতুন নামকরণের ফলে এখানকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নামের বিড়ম্বনায় পড়েছেন। সোমবার (০৯ ডিসেম্বর) সরেজমিনে প্রতিষ্ঠানটিতে গেলে এ প্রতিবেদকের কাছে তারা নামের বিড়ম্বনার বিষয়টি তুলে ধরেন। বলেন, ফ্যাসিবাদ বিদায় নেওয়ার পর এখন এই নাম কেউ আর শুনতে চায় না। ফলে তারা কলেজের পূর্ব নাম ‘খুলনা সরকারি কলেজ’ নামকরণের দাবি জানিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে সাবেক অধ্যক্ষ মোল্লা আমীর হোসেনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এস এম আলী আশরাফ এ প্রতিবেদককে বলেন, সারা দেশে ১৬টি সরকারি কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট ছিল। যার সবকটি সংশ্লিষ্ট এলাকার নামে সাধারণ কলেজে রূপান্তর করা হয়। খুলনাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু শুধুমাত্র ‘খুলনা সরকারি কলেজ’টি পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে ‘সরকারি জয়বাংলা কলেজ’ করা হয়। তবে কেন নাম পরিবর্তন করা হয়- এ প্রশ্নও রয়েছে তার মনে। শুধুমাত্র নামের কারণে তিনি নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন- উল্লেখ করে বলেন, এই নামের মধ্যে সমস্যা রয়েছে। ফলে কোন অথরিটি এই নাম এখন আর নিতে চাচ্ছে না। এমনকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে আমন্ত্রণও করা হয় না। ফলে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এখন এই নামের পরিবর্তন হওয়া দরকার উল্লেখ করে অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এস এম আলী আশরাফ আরও বলেন, পরীক্ষার পর কলেজ বন্ধ থাকবে। ছুটি শেষে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে তিনি শিক্ষক ও সদস্যদের নিয়ে সভা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
অপরাপর সূত্রে জানা গেছে, কলেজটিতে বর্তমানে অধ্যক্ষসহ মাত্র ৮জন শিক্ষকের পদ অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু অনুমোদিত ও সংযুক্ত মিলে বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ২৬জন। এখানে গণিত, আইসিটি, মার্কেটিং ও ফিন্যান্সের মত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কোন শিক্ষক নেই। আবার ইসলামের ইতিহাস ও দর্শন সাবজেক্ট নেই। কিন্তু সাবজেক্ট না থাকলেও শিক্ষক রয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা পাঠদানের পরিবর্তে অন্য কাজ করেই চাকরির সময় পার করছেন।