স্থানীয় সংবাদ

খুলনায় বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সঙ্কট

পবিত্র মাহে রমজানকে সামনে রেখে

# তেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও কোম্পানীগুলো তেল দিচ্ছেনা বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের #
# সিন্ডিকেট বন্ধে নিয়মিত বাজার মনিটরিংসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি ভোক্তাদের #

মো. আশিকুর রহমান ঃ সয়াবিন তেল রান্না-বান্নার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য পণ্য। প্রতিটি পরিবারে প্রতিদিনই সয়াবিন তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। যে কারণে সারাদেশের ন্যায় খুলনায় সয়াবিন তেলের ক্রেতা চাহিদা সারা বছর লেগেই থাকলেও পবিত্র মাহে রমজানে ইফতারী তৈরীতে সয়াবিন তেলের চাহিদা অধিকগুণে বৃদ্ধি পায়। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা ফের পণ্যটির কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মুনাফা লুটে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে বসুন্ধরা, তীর, পুষ্টি, রুপচাঁদা, ফ্রেশসহ বেশ কিছু কোম্পানী বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ করে থাকে। পাশাপাশি খোলা সয়াবিন তেলও খুলনার বাজারে নিয়মিত সরবরাহ হয়ে থাকে। খুলনার বাজারে বোতল তেলের যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও গত ৬/৭ মাস ধরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। নাগরিক নেতারা বলছেন, সরকার বর্তমানে বাজার নিয়ন্ত্রন করতে পারছেনা। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় সিন্ডিকেট করে বোতলজাত তেলের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরী করছে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রন করলে এই সঙ্কট কেটে যাবে।

খুলনার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে খোলা বাজারে পাইকারী ঘরে সয়াবিন তেল পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ (৩৭ কেজিতে মন) ৭০০০ টাকা দরে, যার প্রতি কেজি পড়ছে ১৮৯ টাকা নিশ্চিত করেছেন পাইকারি তেল ব্যবসায়ী জয়নাল। বিপরীতে প্রতিকেজি তেল পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৯২ টাকা দরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দৌলতপুর বাজারের পাইকারি তেল বিক্রেতা জয়নাল। খোলা তেলের বিপরীতে বোতলজাত তেল ১/২ লিঃ ৯২ টাকা, ১ লিটার ১৭৫ টাকা, ২ লিটার ৩৫০ টাকা, ৫ লিটার ৮৫২ টাকা বডিরেট থাকলেও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। অভিযোগ রয়েছে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় তাদের কাছে মজুতকৃত বোতলজাত সয়াবিন তেলে ঢেলে (খোলা) ভাবে বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ৬/৭ মাসের বেশি সময় ধরে খুলনায় বোতলজাত তেল সরবরাহ নিয়ে টানাপড়েন চলছে। বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছে, কোম্পানীতে তেলের সরবরাহ কম। যদি কোনো ব্যবসায়ীকে দু’চার কার্টুন তেল দেওয়া হচ্ছে, তাও আবার শর্ত সাপেক্ষে। সয়াবিন তেল নিতে গেলে তার বিপরীতে চাল, সরিষার তেল, মাসলা বা অন্য কোনো আইটেমের পণ্য (স্লো আইটেম) বাধ্যতামূলক কিনতে হবে, তবেই মিলছে দু’চার কার্টুন সয়াবিন তেল।
বৃহস্পতিবার (১৩ ডিসেম্বর) নগরীর সন্ধ্যা বাজার, নিউ মার্কেট বাজার, দৌলতপুর, খালিশপুর চিত্রালী বাজার, বৈকালি বাজারসহ নগরীর স্থানীয় পাড়া-মহল্লার দোকান ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। খুলনার বাজারে বোতলজাত তেলের উপস্থিতি কমে যাওয়া, অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় বোতলজাত তেল খুলে খোলা তেল হিসাবে বিক্রি করা, বোতলজাত কোম্পানীগুলো ব্যবসায়ীদের তেল সরবরাহের জন্য শর্ত বেঁধে দেওয়াসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে খুলনা ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ওমর ফারুক নামের একজন ক্রেতা জানান, বাজারে বোতলজাত তেলের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। টাকা দিয়েও মিলছে না তেল। চিত্রালী বাজারে আসা অপর ক্রেতা ¯িœদ্ধা জানান, নিত্যপণ্যের বাজারের কি অবস্থা। দীর্ঘদিন ধরে বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট লেগেই আছে। আশ্চর্যের বিষয় বাজার হতে বোতলের তেল যেন উধাও। ৫ লিটার তেল চাইলে দোকানদার দিতে পারছেনা। উত্তরে বলছে, কোম্পানী তেল দেয় না। লাভবান হচ্ছে ব্যবসায়ীরা, আর আমরা ক্রেতারা ঠকবো। নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানাচ্ছি।
দৌলতপুর বাজার নুরুল হক স্টোরের মালিক নুরুল হক জানান, ৬/৭ মাস ধরে কোম্পানীগুলো বোতলজাত সয়াবিন তেল চাহিদা মতো দিচ্ছে না। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও কোম্পানী তেল দিচ্ছে না। ১০ কার্টুন তেল চাইলে দিচ্ছে ২ কার্টুন, তাও আবার ১০/২০ দিন পরে। সাথে অন্য পণ্য চাল, চা-পাতি বা অন্য কিছু নিতে হচ্ছে। তবু মিলছেনা তেল।
খুলনা সন্ধ্যা বাজারের ব্যবসায়ী হোসাইন জানান, তেল কোম্পানীর প্রতিনিধিরা প্রায় ২ সপ্তাহ হলো খোঁজ খবর নেয় না। আমার প্রতি সপ্তাহে ঙ্গ লিটারের ১ কার্টুন, ১ লিটার ২ কার্টুন, ২ লিটার ২ কার্টুন ও ৫ লিটার ৩ কার্টুন তেলের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এই চাহিদা থাকলেও কোম্পানী তেল দিচ্ছে না। যদিও ১/২ কার্টুন তেল পাওয়া যাচ্ছে, তবে শর্ত সাপেক্ষ। তেল নিতে হলে সাথে সরিষার তেল, মসলা, চা-পাতি বা চাল নিতে হচ্ছে, নইলে কোম্পানী তেল দিচ্ছে না। এতে কাস্টমার নষ্ট হচ্ছে।
ব্যবসায়ী মাসুদ জানান, দোকানে এক পিস তেলও নাই। বোতল তেল বিক্রি আর ইচ্ছে নাই। প্রতিনিধিদের কাছে তেল চাইতে চাইতে গলা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। তেল চায় ৩ কার্টুন, দেয় ৬ পিস। সাথে আবার মসলা নিতে হবে। কে এই ঝামেলা পোহাবে। তাই বোতলজাত তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। খুলনার নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী মিরাজ জানান, মার্কেটে প্রতিটি বোতলজাত তেল কোম্পানীর চাহিদার তুলনায় তেলের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে কোম্পানীর প্রতিনিধিরা আসে, মালের অর্ডার নিয়ে চলে যায়, কিন্তু মালের দেখা মেলে না। ৫ কার্টুন মালের অর্ডার দিলে ২ কার্টুন মাল দিচ্ছে। তাও আবার শর্ত সাপেক্ষে। তেল নিতে হলে ওই কোম্পানীর মসলা, চা, চাল বা অন্য কোনো স্লো আইটেম নিতে হবে। ব্যবসা করবো কি করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, কোম্পানী আমাদের যেভাবে তেল দেয়, আমরা মার্কেটেও সেই ভাবে ডেলিভারি দেই। চাহিদার তুলনায় কোম্পানী বর্তমানে তেল কম দিচ্ছে। এই নিয়ে বিক্রেতাদের সাথে প্রতিনিয়ত আমাদের ঝামেলা লেগেই আছে। রুপচাদা বোতলজাত তেল কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, বর্তমানে মার্কেটে বোতলজাত তেলের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। কোম্পানী মার্কেটে তেল কম দিচ্ছে। মার্কেটে তেলের সরবরাহ কেন কম এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সয়াবিন তেলের পরিবেশক জানান, আমাদের চাহিদার তুলনায় কোম্পানীর বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। তাছাড়া আমরা খুচরা ব্যবসায়ীদের যা দিচ্ছি সেটা তারা ঢেলে খোলা তেল হিসেবে বিক্রি করছে ফলে বাজারে বোতলজাত তেলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
পুষ্টির কনজুমার ডিভিশনের এরিয়া ম্যানেজার মো. আতিকুর রহমানকে খুলনার বাজারে চাহিদা তুলনায় কেন বোতলজাত তেলের সরবরাহ কম এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরে তিনি জানান, মার্কেটে তেলের কোনো সরবরাহের ঘাটতি নাই। প্রতিটি দোকানদারকে চাহিদা অনুসারে তেল দেওয়া হচ্ছে। তেলের সরবরাহে অন্য কোনো পণ্য নেওয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে, বিষয়টি জানা নাই।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’র খুলনার সাঃ সম্পাদক এড. কুদরত-ই খুদা জানান, সরকার বর্তমানে বাজার নিয়ন্ত্রন করতে পারছেনা। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় সিন্ডিকেট করে বোতলজাত তেলের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরী করছে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রন করতে এই সঙ্কট কেটে যাবে বলে আমি মনে করি।
ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষন অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মাদ সেলিম জানান, খুলনার বাজারে বোতলজাত তেলের উপস্থিতি কমে গেছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় বোতলজাত তেল খুলে খোলা তেল হিসাবে বিক্রি করছে। তাছাড়া ব্যবসায়ীদের তেল সরবরাহের জন্য শর্ত বেধে দিচ্ছে তেল কোম্পানীগুলো, এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কোনো ভাবেই ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘন মেনে নেওয়া হবে না।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button