‘হিট স্ট্রোকের’ কবলে খুলনার পোল্ট্রি খাত

# হিট স্ট্রোকে পড়ে মারা যাচ্ছে বহু সংখ্যক ব্রয়লার মুরগি, লোকসানের মুখে ব্যবসায়ীরা #
# হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে দিনে ভ্যাকসিন করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের #
# তীব্র তাপদাহ্ েচরম ঝুঁকি ও শঙ্কাতে প্রান্তিক খামারিসহ পরিবেশকগন #
মো. আশিকুর রহমান : গরীবের একমাত্র আমিষের চাহিদা পূরনের বড় ভূমিকা পালন করে আসছে ফার্মের মুরগী, বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগি। খুলনাঞ্চলের ফুলতলা, জামিরা, পথের বাজার, দিঘলিয়া, তালা, বটিয়াঘাটা, তেরখাাদা, কৈয়া বাজার, ডুমুরিয়াসহ স্থানীয় এলাকার হতে খুলনার স্থানীয় পাইকারি ও খুচরা বাজার গুলোতে প্রতিদিনই সরবরাহ হয়ে থাকে ব্রয়লারসহ অন্যান্য ফার্মের মুরগি। বিশেষ করে এই এলাকার প্রচুর পরিমানে চাহিদা রয়েছে ব্রয়লার মুরগির। কিন্তু সম্প্রতি তাপ প্রবাহের কারণে হিট স্ট্রোকের ঝুঁিকতে পোল্ট্রি খাতের সাথে সম্পৃক্ত কর্পোরেট ফার্ম, প্রান্তিক পর্যায়ের খামারী, পরিবেশকসহ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা চরম শঙ্কায় দিন গুনছেন। কারণ হিসাবে জানা গেছে, গ্রীষ্মের তীব্র তাপপ্রবাহে অতিষ্ট হয়ে উঠছে চারপাশ, চারদিক। অস্বস্তিকর অগ্নিদহনে প্রানহীন হয়ে উঠেতে শুরু করেছে চারপাশের প্রকৃতি। এই অসহনীয় গরম কেবল জনজীবনের উপরই প্রভাব ফেলছে না, একই সাথে পোল্ট্রি খাতের চরম প্রভাব ফেলছে। তীব্র তাপদাহ্ েপড়ে প্রতিদিনই হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে শত খামারিসহ পরিবেশকগনের রক্ষণাবেক্ষনকারী ফার্মের মুরগী, বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগি। দিন-রাত খামারগুলোতে ফ্যান চালিয়ে, খাবার স্যালাইন ও মুরগিতে ঠান্ডা রাখতে সহায়ক মেডিসিন প্রয়োগ করেও নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না হিট স্ট্রোক। খামারিরা জানিয়েছেন- তীব্র তাপ প্রবাহের কারনে মুরগি হিট স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছে। যখন স্ট্রোক করে তখন মুরগিগুলো হাফিয়ে যায়। হাফিয়ে গেলে মুরগি বাড়ন্ত হয়ে উঠতে বাধাগ্রস্থ হয়। এমতাবন্থায় ওই মুরগি যে পরিমান খাবার খাওয়ার কথা সেই পরিমান খায় না। তখন ক্ষতির সম্মুখিন হওয়ার সম্ভবনা দেখা দেয়। খামারে পর্যাপ্ত বাতাসের ব্যবস্থা থাকলও যে পরিমানে গরম পড়ছে, তাতে বাতাসেও কাজ হচ্ছে না। প্রান্তিক খাবারিরা শীত ও গরম দু’টোতেই ঝুঁকি ও শঙ্কায় থাকেন। শীতের সময়ে অতিমাত্রার ঠান্ডার কারনে মুরগী মরে এবং গরমের সময়ে তাপ প্রবাহের কারনে হিট স্ট্রোকে মারা যায়, তবে বৃষ্টির সময়ে ঠান্ডা বা গরমে কোনো ঝুঁকি না থাকলেও বড়সরো প্রাকৃতিক দূর্যোগে পড়ে ক্ষয়-ক্ষতির সম্ভবনা থাকে। বর্তমানে মাত্রারিক্ত গরমের কারনে চরম ঝুঁকি ও শঙ্কাতে এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।
নগরীর দৌলতপুরস্থ পাবলা কারিকর পাড়া এলাকার মের্সাস লিয়াকত পোল্ট্রি ফার্মের সত্ত্বাধিকারী মো. শাহিদুর রহমান টিটো জানান, তীব্র গরমের কারনে ব্যাপক পরিমানে মুরগি হিট স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছে। সাধারনত বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে এই স্ট্রকের প্রবনতা দেখা দেয়। এসময় মুরগিগুলো হাপিয়ে ওঠে। হাফিয়ে গেলে মুরগি বাড়ন্ত হয়ে উঠতে বাধাগ্রস্থ হয়। এমতাবন্থায় ওই মুরগি যে পরিমান খাবার খাওয়ার কথা সেই পরিমান খায় না এবং মারা যায়। আমরা খামারে পর্যাপ্ত বাতাসের ব্যবস্থা বিশেষ করে ২৪ ঘন্টা ফ্যান চালিয়ে রাখছি, স্যালাইনসহ মেডিসিন খাওয়াচ্ছি তবু হিট স্ট্রোক থেকে রেহাই মিলছে। পাশাপাশি বর্তমানে উৎপাদন বেশি, তবে চাহিদা না থাকায় আরো লোকসানের মুখে পড়ছি। সবমিলিয়ে বর্তমান সময়ে চরম ঝুকি ও শঙ্কার মধ্যে আছি।
ফুলতলা উপজেলার দামোদর এলাকার খামারি শান্তনু বিশ^াস জানান, প্রতি বছরই হিট স্ট্রোকে পড়ে বহুসংখ্যর মুরগি মারা যাচ্ছে। বর্তমানে আমার খামারে ৭’ ব্রয়লার মুরগি আছে। যার প্রতিটির ওজন ২ কেজি করে। গরমের কবলে হিট স্ট্রোক করে প্রতিদিন ২/৪ মুরগি মারা যাচ্ছে। ২৪ ঘন্টা ফ্যান চালিয়ে রাখছি, উন্নতমানের স্যালাইন খাওয়াচ্ছি, সাথে মুরগির শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য মেডিসিনও খাওয়াচ্ছি। তারপরও বর্তমানে তীব্র গরমের কারনে মুরগি নিয়ে শঙ্কা ও ঝুঁকিতে আছি। সামনে তো গরম আরো বাড়বে।
সাদিক পোল্ট্রি এন্ড ফিড এর সত্ত্বাধীকারি টিপু মোল্যা জানান, প্রতিবছরই অতিরিক্ত গরমের কারনে খামারি ও পরিবেশকরা ব্রয়লার মুরগি হিট স্ট্রোকের সম্ভবনা বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে ব্যবসায়ীরা চরম ঝুকিতে থাকে। তবে এসময় সঠিক পরিচর্চা বিশেষ করে পর্যাপ্ত বাতাসের ব্যবস্থা, সঠিক নিয়মে খাবার পরিবেশন, দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত মুরগিকে খাওয়া হতে বিরত থাকা, পাশাপাশি ম্যানেজমেন্টকে সঠিক ভূমিকা পালন করাসহ বিবিধ বিষয়ে খেয়াল রাখলে কম মুরগি কম মারা যাবে।
ডুমুরিয়া উপজেলার কৈয়া এলাকার খামারি রহিম জানান, প্রতি বছরই শীতের সময় ঠান্ডায় আর গরমের সময়ে অধিক গরমে মুরগি মারা যায়। এ বছর এখনো পুরাদমে গরম পড়া শুরু করেনি, তারপরও প্রতিদিন হিট স্ট্রোকে মুরগি মারা যাচ্ছে। সারাদিন খামারে ফ্যান চালিয়ে রাখছি, স্যালাইন খাওয়াচ্ছি, মুরগিকে ঠান্ডা রাখার জন্য মেডিসিন খাওয়াচ্ছি তবুও স্ট্রোক পড়ে মুরগি মারা যাচ্ছে। মানুষই গরমে অস্থির হয়ে উঠছে, আর মুরগি!
খুচরা মুরগি বিক্রেতা নয়ন জানান জানান, বর্তমানে ব্যাপক গরম পড়তে শুরু করেছে। আমি স্থানীয় এলাকা বিশেষ করে ফুলতলার জামিরা এলাকা হতে পাইকারি মুরগি কিনে নিয়ে খুচরা বাজারে বিক্রি করে থাকি। বর্তমানে এমন গরম পড়ছে যে, দিনের বেলায় ভ্যানে করে মুরগি আনা যাচ্ছে না। আনতে গেলেই রোদে খাচার ভেতর দু’চারটা মুরগি হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে। কোনো উপায় নেই, দোকান ফাকা তবুও দিনের বেলায় মুরগি আনছি না, সন্ধ্যার পর গরম কমলে মুরগি আনবো।
এ বিষয়ে দিঘলিয়া উপজেলার ভেটেরিনারী সার্জন ডা. মো. শাহাদাত হোসেন জানান, এসময় বাড়তি সচেনতাটা বেশি জরুরী। বিশেষ করে টিনের সেডের খামার হলে, সেডের নিচে ইনসুলেটর ব্যবহার করতে হবে। ৩/৪ ঘন্টা পর পর পানি পরিবর্তন করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পানি পান করানো। ওই পানি সাথে অবশ্যই ভিটামিন সি খাওয়াতে হবে। পর্যাপ্ত বাতাসের ব্যবস্থা রাখা। অনেকে চটের বস্তা দিয়ে খামার ডেকে রাখে, এটা ঢেকে রাখা যাবে না। সবচেয়ে গুরুত্বর্পূন একটা বিষয়, এসময় যদি মুরগিকে ভ্যাকসিন করতে হয়, তবে অবশ্যই ভোরে (৬ টার আগে) করতে হবে। অনেকেই ভূল করে দিনের বেলায় ভ্যাকসিন করে থাকেন, কোনো অবস্থাতেই দিনের বেলায় ভ্যাকসিন করা যাবে না, এতে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি আরো বাড়বে।
খুলনা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. মিজানুর রহমান এ জানান, যেহেতু গরম কাল চলছে, তাই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া সাধারনত এপ্রিল মে মাসে গরমের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। বৃষ্টিপাত কম থাকার কারনেই এমন গরম অনুভুত হচ্ছে। বর্তমানে তাপপ্রবাহ চলছে, গতকাল খুলনার তাপমাত্রা ৩৬.০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং খুলনা বিভাগের সর্ব্বোচ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৩৭.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস।


