কেডিএ ও কেসিসির সমন্বয়হীনতায় খুলনায় হাজার হাজার যাত্রীর দুর্ভোগ চরমে

# আটকে আছে সোনাডাঙ্গা বাইপাসের ৭৮০ মিটার সড়ক
# খুলনা সোনাডাঙ্গা থানার বিপরীত সড়ক হতে ময়ুর ব্রীজ হয়ে জয়বাংলার মোড় পর্যন্ত সড়কের জমি জটিলতা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগের অভাব #
# আসন্ন বর্ষায় চরম ভোগান্তির অপেক্ষায় নগরবাসী
# এই এলাকায় বাসে চড়ে আসার পর হাজার হাজার যাত্রী চরম ভোগান্তিতে পড়ে
কামাল মোস্তফা ঃ খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানার পাশ থেকে ময়ুর ব্রিজ পর্যন্ত ৭৮০ মিটার সড়কটি রাস্তা প্রশস্তকরণে জমি জটিলতায় আটকে আছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে বছরজুড়ে ভোগান্তির পাশাপাশি আরও এক বর্ষা কাটবে এ রাস্তায় চলাচলকারীদের। খুলনা শহরের প্রবেশদ্বার এ সড়কটি বছরের পর বছর জোড়াতালি দিয়ে রাখায় ক্ষুদ্ধ এ রাস্তা ব্যবহারকারীসহ নগরবাসী। প্রতিদিন শত শত যাত্রীবাহী পরিবহন ও মালবাহী ট্রাকসহ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে দক্ষিণবঙ্গের জেলা উপজেলাগুলোতে যাতায়াতের প্রধান পথে বরাবরের মত চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) সূত্রে জানা যায়, সোনাডাঙ্গা মডেল থানার পাশ থেকে ময়ুর ব্রিজ পর্যন্ত ৭৮০ মিটার সড়কটি জার্মান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারলেনে উন্নীত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সড়কের দু’পাশে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রেখে ড্রেন নির্মাণসহ হাইওয়ে স্টান্ডার্ডে এটি তৈরির কথা বলা হয়েছে। ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও জমি সংক্রান্ত জটিলতায় টেন্ডার আহবান করতে পারছেনা কেসিসি। সূত্রে আরো জানা যায়, প্রস্তাবিত ৬০ ফিট চওড়া রাস্তাটি বর্তমানে কিছু কিছু যায়গায় আছে ৩০-৩৫ ফিট। কোথাও আবার তারও কম। রাস্তাটি কেডিএর হওয়ায় জমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের দায়িত্ব খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে কেডিএ ও কেসিসির সমন্বয়হীনতায় আটকে আছে রাস্তার কাজ। সর্বশেষ ২০২২ সালে স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে সড়কটি সংস্কার করে কিছুটা চলাচলের উপযোগি করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলায় টেকসই ব্যবস্থা না করায় চলাচলের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে আছে রাস্তাটি।
কেডিএ সূত্রে জানা যায়, ২০০৯-২০১০ সালে রাস্তার জন্য ৬০ ফিট জমি অধিগ্রহণ করে সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়। ৭৮০ মিটার রাস্তার একটি অংশে দুটি মৌজার (দেনারাবাদ ও বানিয়াখামার) সীমানা বিদ্যমান। ফলে পূর্বের ম্যাপ অনুযায়ী জমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া জমি অধিগ্রহণ করে নির্ধারণ করা বেশিরভাগ সীমানা পিলারের অস্তিত্ব নেই। অধিগ্রহণ করা জমির অনেক জায়গায় বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সিটি কর্পোরেশন, কেডিএ ও ডিসি অফিসের সার্ভেয়ার বহুবার মাপঝোপ করেও সীমানা জটিলতার সমাধান করতে পারেনি। সড়কের পাশের ব্যবসায়ীরা বলেন, বছরখানেক হলো সড়কটিতে ইটের সোলিং করা হয়েছে। ইতিপূর্বে সড়কটিতে ইটের সোলিং ও ছিলো না। যানবাহন চলাচলের জন্য সড়কটি ছিলো মরণফাঁদ। সড়কের মাঝখানে বড় বড় গর্ত তৈরী হয়েছিলো। বর্ষা মৌসুমে কর্দমাক্ত পরিবেশ বিরাজ করতো। এমন দুরবস্থার কারণে সড়কটি দীর্ঘদিন যান চলাচল বন্ধ ছিলো। সামনে আবারও বর্ষা অথচ রাস্তাটি নির্মাণ বা সংস্কারে তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। স্থানীয় বাসিন্দা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমি আরাফাত নগরের ভেতরে থাকি। সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে আমাদের বাসায় যেতে এবং বের হতে অনেক পথ ঘুরে শহরে যেতে হয়। রোগী কিংবা বৃদ্ধরা এই সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারেন না। সড়কের অবস্থা বেহাল।’ এ প্রসঙ্গে খুলনা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্জ্ব আব্দুল গফফার বিশ্বাস বলেন, দেশের সংস্কার কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু এখানে খামখেয়ালী ও দুর্নীতিতে যারা অভ্যস্ত তারা চেয়ারেই রয়ে গেছে। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের খামখেয়ালীপনা ও কেডিএর রাস্তার প্রশস্তা নিয়ে নির্লিপ্ততায় হাজার হাজার যাত্রীর দুর্ভোগ হচ্ছে। শত শত গাড়ি নষ্ট হয়ে এই পথে গাড়ীর মালিকদের কোটি কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। সবখানে সংস্কার প্রয়োজন। এখানে যারা গাফিলতি করছে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হলে দেখবেন ওই রাস্তার কাজ দ্রুত গতিতে শেষ হয়ে যাবে। নিরাপদ সড়ক চাইয়ের খুলনা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান মুন্না বলেন, খুলনা মহানগরীর প্রবেশ দুয়ার হিসেবে পরিচিত সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল সংযোগ সড়কটি । অতি গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক দিয়ে ১৮টি জেলার পরিবহন নগরে যাতায়াত করে। বিশেষ করে ঢাকা, বরিশাল, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা রুটে চলাচল করা গণপরিবহনগুলো সড়কটি বেশি ব্যবহার করে। তবে এক দশক ধরে সড়কটি জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকলেও সংস্কারে উদ্যোগ নেয়নি খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) ও খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। শুধুই রশি টানাটানি। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা মানববন্ধন করেছি একাধিকবার। তারপরও কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যা খুলনাবাসীর জন্য দুঃখের খবর। তিনি আরও বলেন, খুলনার সাবেক অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক শেখ হাসিনার উন্নয়নের বানোয়াট গল্প শোনাতেন। খুলনাকে সিঙ্গাপুর বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে কেটে গেছে দীর্ঘ ১৫ বছর। অথচ খুলনার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো এখনো বেহাল অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে সোনাডাঙ্গা বাইপাস সড়ক ও খুলনা শিপইয়ার্ড সড়কের কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা আবার দাবি জানাচ্ছি অবিলম্বে খুলনার গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কগুলো যেন সংস্কার করা হয়। খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি আশরাফ হোসেন বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে এই সড়কটি বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। খুলনার শহরের প্রবেশ এবং বাহির হওয়ার প্রধান সড়ক এটি। সম্প্রতি আমরা কেসিসির সাথে বসে জনগুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটির কাজ শুরু করার তাগিদ দিয়েছি। জটিলতা থাকলে তা সমাধান করে দ্রুততম সময়ে কাজ শুরু ও শেষ করতে হবে।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবির-উল-জব্বার বলেন, সড়কটি নির্মাণকাজে আমাদের আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই। সড়কটি ড্রেন ও মাঝখানে ডিভাইডারসহ ৬০ ফুট হবে। কিন্ত বর্তমানে রাস্তাটির সবখানে প্রয়োজনীয় জমি নাই। যেহেতু রাস্তাটি কেডিএর, জমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন তারাই করবেন। এ বিষয়টি নিয়ে কেডিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে অসংখ্যবার মিটিং করা হলেও সমাধান হচ্ছেনা। রাস্তা প্রশস্ত করণে প্রয়োজনীয় জমির জটিলতা কাটলে টেন্ডার আহবান করতে পারবো।
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহি প্রকৌশলী(প্রকল্প) মারতোজা আল মামুন বলেন, রাস্তাটি নির্মাণে জমি সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে। ২০১৩ সালে কেডিএ রাস্তাটি নির্মাণের আগে ৬০ ফিট জমি অধিগ্রহণ করে। বেশিরভাগ জায়গায় ৬০ ফিট থাকলেও দুএক জায়গায় জমি কম আছে। জনগণের দূর্ভোগের কথা ভেবে কম থাকা জমির অংশটুকু বাদে বাকি অংশের কাজ শেষ করা উচিত। এ ছাড়া কেসিসি সোনাডাঙ্গা সংলগ্ন এম এম বারি সড়ক লাগোয়া রাস্তার মুখে থাকা কেডিএর বাণিজ্যিক প্লটের কিছু জমি রাস্তার জন্য ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছে। কিন্তু বাণিজ্যিক প্লটের জমি হস্তান্তরের সাথে আর্থিক বিষয় জড়িত। কিন্ত কেসিসি সে বিষয়ে আগ্রহ না দেখানোয় কাজ বিলম্বিত হওয়ার আরো একটি কারণ। তবে উভয় পক্ষ বসে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাস্তাটির নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে আশা করছি।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে খুলনা সিটি বাইপাস সড়ক নির্মাণ করে কেডিএ। যদিও সড়ক নির্মাণের এক বছরের মাথায় তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। আট-নয় বছরে সড়কটি সংস্কার না হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন সিটি বাইপাস সড়ককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও সাধারণ মানুষ।
কিন্তু খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ২০১৫ সালে সড়কটি নির্মাণের পর ২১৬০ মিটার সড়কের মধ্যে ১৩৮০ মিটার অর্থাৎ ময়ুর ব্রিজের পর থেকে জয় বাংলার মোড় পর্যন্ত সংস্কারের জন্য এলজিআরডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর ময়ুর ব্রিজের আগ থেকে সোনাডাঙ্গা মডেল থানা পর্যন্ত ৭৮০ মিটার খুলনা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে তালুকদার আব্দুল খালেক মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ তুলে সড়কের দায়িত্ব নিতে চাননি।
এ অবস্থায় ২০২১ সালের শেষ থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ময়ুর ব্রিজের পর থেকে জয় বাংলার মোড় পর্যন্ত ১৩৮০ মিটার সড়ক সংস্কার করে এলজিআরডি। ময়ুর ব্রিজের আগ থেকে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ৭৮০ মিটার বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকে। এ অবস্থায় জনদুর্ভোগ দূর করতে স্থানীয়রা ব্যক্তি উদ্যোগে সড়ক সংস্কার করে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে।
সড়কটি সংস্কারের জন্য ২০২২ সালের শুরুতে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এক বছর অতিবাহিত হলেও সেই প্রকল্প আলোরমুখ দেখেনি। সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশন জার্মান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। নকশা প্রস্তুত করা হলেও জমি সংক্রান্ত জটিলতায় টেন্ডার আহবান করা যায়নি। ফলে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে সড়কের নির্মাণ কাজ।