স্থানীয় সংবাদ

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি : রয়েছে মজুরি বৈষম্য-ঝুঁকি

# খুলনার বরফ শ্রমিকদের চিত্র #
# মহান মে দিবস আজ #

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান : নেই কোন ধরনের নিয়োগপত্র। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না কোন ধরনের পরিচয় পত্রও। নেই কর্ম ঘন্টারও কোন হিসেব। তবে রয়েছে মজুরি বৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফ শ্রমিকদের। অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত এই শ্রমিকরা জানেন না মে দিবসের অর্থ, এমনকি জানার চেষ্টাও করতে চান না। তারা শুধু এটুকুই জানেন, কর্ম থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। এ অবস্থার মধ্যে দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মে দিবস।
খুলনার নতুন বাজার, রুপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের বাস্তব চিত্র।
সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এখানে প্রচন্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডা জনিত অসুস্থতা এবং পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পাও কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরী নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রুপসা উপজেলার পূর্ব রুপসা এলাকায় ছোট বড় মিলিয়ে আনুমানিক ১৫/১৬ টি বরফ কল রয়েছে। এরমধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফ কলের অবস্থান। এসব বড়ফ কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।
রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ নামক বরফ কলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার পরিজন নিয়ে থাকেন রূপসার জাবুসা এলাকায়। দীর্ঘ সাত বছর ধরে কর্মরত রয়েছেন তিনি। বরফ কলের এই শ্রমিক বলেন, তাদের কোন মাসিক বেতন নেই, নেই কোন নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত : উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে গড়ে চারজন করে শ্রমিক মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না। তিনি বলেন, তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ এ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মত শ্রমিকদের কোন বেতন- বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরী আছে কাজ না থাকলে মজুর নেই। এ পদ্ধতিতেই তাদের কাজ করতে হয়। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরি থাকে না।
একই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক মোঃ জাকির হোসেন বলেন, গড়ে প্রতিমাসে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকার মতো মজুরি পান। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ হিসেবে ২৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আবার বাসা ভাড়া বাবদ দুই থেকে তিন হাজার টাকা চলে যায়। তবে তিনি ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই আবাসিক বসবাস করলেও বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।
বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১ এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করেন রুপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। তিনি বলেন, তার বর্তমান বয়স ৮৪, তবে ১৮ থেকে ২০ বছর বয়স থেকেই তিনি বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সব সময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘন্টাই কারখানা থাকতে হয়, কোন ছুটি পান না। বলেন, অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে উল্লেখ করেন।
মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজের শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, তার বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার জিউধরা গ্রামে। চার বছর ধরে বরফকলে কাজ করছেন। কর্মসংস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, বরফলের চাকরির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয় না হলে হয় না। এখানে চাকরির কোন নিশ্চয়তা নেই। নিয়োগপত্র ও পরিচয় পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বা মজুরি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একই এলাকার ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে কর্মরত শ্রমিক মোঃ মুন্না গাজী ও মো: হাসান শেখ বলেন, তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তাদের প্রতিষ্ঠানে মাসিক ১০ হাজার টাকা হিসেবে বেতন প্রদান করা হয়। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।
এ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আশিকুর রহমান স্বীকার করেন, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কর্মরত শ্রমিকদের কোন অ্যাপ্রোন বা ড্রেস প্রদান করেন না। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝে মধ্যেই লিকেজ হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২ টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে ছয় জন শ্রমিক কর্মরত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২’র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে ৬০০ পিস বরফ উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন চাহিদা অনুযায়ী ২০০ থেকে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে থাকেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস মোটামুটি উৎপাদনে থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস উৎপাদন কম থাকে। ফলে কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে বেশ লোকসান গুণতে হয়।
জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরের জন্য অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।
বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১’র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ- উল- জান্নাত সৈকত বলেন, ব্যবসাটি খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল সহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়। তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রুপসা ভেরীবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের (রেজিস্ট্রেশন নং ১৪৮৭) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফ কলের ৩৫ থেকে ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে কোন অভিযোগ নিয়ে ইউনিয়নে কেউ আসে না। ফলে বরফকল শ্রমিকরা মোটামুটি ভালো আছেন বলে প্রতিমান হয়। শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button