স্থানীয় সংবাদ

খুলনা অঞ্চলে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও মিলছে না সরকার নির্ধারিত মূল্য

# চালকল মালিকদের একচ্ছত্র ভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ
# সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে বাড়তি পরিবহন খরচ, বিক্রয়ে অনিশ্চয়তা ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ নানা প্রক্রিয়াগত জটিলতা
# প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকরা ধানের রেট ও সংগ্রহের সময় সম্পর্কে না জানা#

এম রুহুল আমিন ঃ খুলনা বিভাগে ১০টি জেলার ৭৪ টি সেন্টারে ধান সংগ্রহ শুরু করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। ২৪ এপ্রিল হতে সারাদেশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বোরো ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ধান ক্রয় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার ৩৭ মেট্রিক টন ও চাল ক্রয় করবে প্রায় ১লক্ষ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। ৪ মে পর্যন্ত তথ্যে জানা যায়,খুলনা জেলায় দশটি সেন্টার সংগ্রহের ধান ক্রয় করবে ৪৮৭১ মেট্রিক টন। সাতক্ষীরা জেলার নয়টি সংগ্রহের ধান ক্রয় সেন্টারে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫৩৫৬ মেট্রিক টন এর মধ্যে সাতক্ষিরা জেলায় ৩৯ মেট্রিক টন মাত্র ক্রয় করা হয়েছে। ২০২৫ সালের বোরো মৌসুম থেকে ১৪ লাখ টন চাল ও ৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। গতবারের তুলনায় এবারের মৌসুমে ধান ও চালের সংগ্রহমূল্য ও বাড়িয়েছে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়।ধানের নির্ধারিত মূল্য ধান ৩৬ ও চাল ৪৯ টাকা।সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সবচেয়ে বেশি ধান ও চাল সংগ্রহ করে থাকে বোরো মৌসুমেই। ২০২৪ সালের বোরো মৌসুমে ১১ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ১ লাখ টন আতপ চাল এবং ৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। ওই সময় প্রতি কেজি ধান ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা এবং আতপ চাল ৪৪ টাকায় সংগ্রহ করা হয়েছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, খুলনা অঞ্চলে ২লক্ষ ১০ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। তারমধ্যে ৮২ শতাংশ জমির ধান কাটা সম্পূর্ণ হয়েছে। কৃষকের বাম্পার ফলন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষকরা ঝামেলা ছাড়াই ধান ঘরে তুলতে পারবেন। এবার ধানে রোগ বালাই কম হয়েছে।গত বোরো মৌসুম থেকে এ বছর হেক্টরে ৪ শুুত কেজি বেশি উৎপাদন হয়েছে। ধান-চাল কেনায় সরকারি উদ্যোগ অতি সামান্য হওয়ায় ধানের বাজারে তা খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে না এ প্রবণতার কারণে প্রতিবছর চালকল মালিকদের (মিলার) একচ্ছত্রভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে।কৃষকরা বলছেন, সরকারি গুদামের চাহিদা অনুযায়ী ধান প্রস্তুত করতে গেলে প্রতি মণে আরও ৫-৭ কেজি কমে যায়। এছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে বাড়তি পরিবহন খরচ, বিক্রয়ে অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ নানা প্রক্রিয়াগত জটিলতায় পড়তে হয়। এ কারণে খোলাবাজারেই ধান বিক্রি করছেন কৃষক।২৪ এপ্রিল থেকে ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষেরা ধানের রেট ও সংগ্রহের সময় সম্পর্কে জানে না। এজন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে মাইকিং করে সকলকে জানানোর ব্যবস্থা করলে সরকারের উদ্যোগ ফলপ্রসু হবে। খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলে হাটে উঠতে শুরু করেছে বোরো ধান। প্রকারভেদে ধানের দাম দিচ্ছে ব্যাপারীরা। তাতে কৃষক তার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। আর যে কারণেই এসব ক্ষতির মুখে পড়ছে। সার,ওষুধের ও ধান কাটা শ্রমিকের শ্রমের মজুরি বেশি তাতে কৃষক ধান থেকে লাভ করতে পারছে না। কোন এলাকায় দেখা যায় সুদী মহজনদের টাকা পরিশোধ করতে কম দামে ধান বিক্রি করে। কিছু কিছু ধান ব্যবসায়ীরা রয়েছে কৃষকের কাছ থেকে মোটা ধান ৯৫০ টাকা করে ক্রয় করছে। ফসল ঘরে তোলার আগেই দাদন ও কিস্তির টাকার জন্য মাঠেই হাজির সুদখোর মহাজন ও এনজিও কর্মীরা। একই সঙ্গে চাষিদের এমন অর্থনৈতিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভিড় করছেন মধ্যস্বত্বভোগী মজুতদার ও ফড়িয়া সিন্ডিকেটের লোকজন। তাই খরচ ও ঋণ মেটাতে নতুন ধান মাঠ থেকেই অনেক চাষি সাড়ে ৯শ থেকে এক হাজার টাকা মন দরে সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ তাদের মনপ্রতি উৎপাদন খরচ ৯শ টাকারও উপরে।
তেরখাদা উপজেলার আজগড়া ইউনিয়নের বোরো চাষী ও কৃষি উদ্যোক্ত আসাদুর রহমান শুভ্র জানান তিনি এবার ৮ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। কিন্তু ধান কাটা শ্রমিকের মূল্য বেশি ও ব্যাপারীরা ধানের দাম কম দেওয়ায় লাভ করতে পারছেন না। তেরখাদা বাজার ধানের দাম মোটা ১ হাজার ২০ টাকা আর চিকন ধান ১২শত টাকায় ধান বিক্রি করতে হয়েছে ফড়িয়াদের কাছে। টাকার প্রয়োজনে কৃষকরা কম দামে ধান বিক্রি করছে। সরকার ধানের মূল্য দিয়েছেন ১৪৪০ টাকা। প্রথম দিকে ধানের দাম বেশি থাকলে বর্তমানে কমিয়ে দিয়েছে ধান ব্যবসায়ীরা।কৃষক সহ কৃষি সংগঠনের নেতারা বলছেন,কৃষি কার্ড নতুন করে আপগ্রেডিটেশন করা, ইউনিয়ন পর্যায়ে ধান সংগ্রহ ও স্টোরেজ ব্যবস্থা করা.ধান ও চাল সংগ্রহের সরকারি মূল্যের সংবাদ ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষকদের সচেতন করা,সরকারের ধান চাল সংগ্রহের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সভা ও প্রচারণা চালানোর দাবি জানান,যদি ইউনিয়ন পর্যায়ে ধান সংগ্রহ ও স্টোরেজ ব্যবস্থা করা যায় তাহলে কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবার সুযোগ বাড়বে। সেজন্য কৃষকরা যখন ধান কাটে তখন তাদের নগদ টাকার প্রয়োজনে সাড়ে ৯০০ থেকে হাজার টাকায় ধান বিক্রি করে দেন। কৃষক নেতারা বলছেন,একটি উপজেলায় এক লক্ষ থেকে দেড় লক্ষ মেট্রিক টন তারও বেশি ধান উৎপাদন হয়। কিন্তু সেখানে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে ১৫০০ থেকে ২০০০ মেট্রিক টন। ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতে পারলে কৃষকদের জন্য ভালো হয়। ধান সংগ্রহ কৃষকদের অ্যাপস এর মাধ্যমে করা হলে এটা জটিল। এতে করে কৃষক বেশি একটা আগ্রহী হয় না। অনেকে আছেন যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কৃষি কার্ড পায়নি।দেখা যাচ্ছে যাদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ কৃষির সাথে তেমন সম্পৃক্ত নয়। যারা ধান উৎপাদন করেন তাদের কাছ থেকে যেন ধান কেনা হয়। এবার ধানের দাম লাভজনক এবং লোভনীয়। লাভটা যাতে কৃষকের ঘরে যায়। কৃষকদের এই বিষয়ে সচেতন করার জন্য প্রত্যেক উপজেলায় একাধিক অবহিতকরণ সভা আয়োজন করা যেতে পারে। এই কাজগুলো আন্তরিকতার সাথে করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পোষণ করেন। ধানের সংগ্রহ বাড়ানোর বিশেষ প্রয়োজন।
খুলনার দৌলতপুর মেট্রো এলাকার কৃষক লিকু শেখ, বিল্লাল হোসেন ও শাহিন মিয়া জানান ধানের সরকার নির্ধারিত মূল্য আমরা পাইনা। প্রতিবছর ধান করলেও সেই ধানগুলো সরকারকে দেয়ার সুযোগ আমাদের নেই। তাই ব্যাপারীদের কাছে ১০০০ টাকা থেকে ১০৫০ টাকায় ধান বিক্রি করছি। তাও তাদের মিলে পরিবহন করে দিতে হবে। ডুমুরিয়ার ১১ নং ইউনিয়নের ৩ ওয়ার্ডের কৃষকরা জানান,আমরা প্রতি বছর ধান চাষ করি কিন্তু আমাদের কোন কৃষি কার্ড নেই। যাদের কার্ড আছে তারা ধান চাষ করে না। কিন্তু সকল সুবিধাই ভোগ করে। কৃষি অফিস যেন এই কার্ডগুলো পুনরায় বিবেচনা করে যারা প্রকৃত কৃষক তাদেরকে দেয়া হয়। আমরা জানিও না সরকার কত মূল্য নির্ধারণ করেছে। ফরিয়া ব্যবসায়ীরা আমাদের মাঠে এসে চিকন ২৮ প্রকৃতির ধানটা নিচ্ছে ১২০০ থেকে ১২৬০ টাকা। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই সরকার কৃষকের দোরগোড়া থেকে ধান সংগ্রহ করলে আমরা উপকৃত হব। দিঘলিয়া উপজেলা কৃষকরা জানান আমাদের এই উপজেলা এখনো ধান সংগ্রহ উদ্বোধন করা হয়নি। আর আমাদের ধান বিক্রি করতে মহেশ্বরপাশা সিএসডি তে যেতে হয় আর তা না হলে ফুলতলা এখানে খরচ অনেক বেশি তাই আমাদের দ্বারা সম্ভব হয় না। আবার ধান নিয়ে গেলে হয়রানি শিকার হতে হয়। এভাবে হয়রানি শুরু করে যার জন্য আমরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে ইচ্ছে হয় না।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button