স্থানীয় সংবাদ

খুলনায় বিভিন্ন স্থানে ৪৭ দিনে ১৮ খুন

# খুলনার নদ-নদী থেকে লাশ উদ্ধারের ঘটনায় বাড়ছে আতঙ্ক
# হাতের টিস্যু পঁচে যাওয়ায় অধিকাংশই লাশ সনাক্ত হচ্ছে না
# বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হচ্ছে লাশ
# যৌথ বাহিনীর নানা অভিযান অব্যাহত

কামরুল হোসেন মনি ঃ খুলনায় একের পর এক নদ-নদী থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বাড়ছে। মৃত ব্যক্তিদের অধিকাংশই হাতের টিস্যু পঁচে যাওযায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিচয় সনাক্ত করতে পারছে না পুলিশ। ফলে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হচ্ছে ওইসব লাশগুলো। গত ৪৭ দিনে খুলনায় বিভিন্ন স্থানে ১৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নদী থেকেই লাশ উদ্ধার হয় ৯ জনের। সন্ত্রাসী ও অপরাধী গ্রেফতারে পুলিশের পাশাপাশি সেনা, নৌ ও র‌্যাবের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনীর নানা অভিযান চলমান রয়েছে খুলনায়। এসব অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী, তাদের সহযোগী এবং কথিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ধরা পড়ছে। তারপরও দীর্ঘ হয়ে চলেছে লাশের মিছিল।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের বরাতে প্রকাশিত হত্যাকান্ড বা লাশ উদ্ধার সংক্রান্ত তথ্যের নথিপত্র ঘেটে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির এই ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। গত ৯ জুন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আঠারোবেকী নদী থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয়রা রূপসা শ্রীফলতলা ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন আঠারোবেকী নদীতে কচুরীপানার মধ্যে একটি লাশ ভেসে থাকতে দেখে থানাকে অবগত করে।
নৌ-পুলিশ রূপসার ইনচার্জ মো: ফারুক হোসেন বলেন, ওই লাশটি পাাইকগাছা নৌ-ফাড়ির এলাকার মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে তার লাশের পরিচয় পাওয়া গেছে কি না তারাই ভালো বলতে পারবে। এর আগে নিহত যুবকের পরিচয় নিশ্চিতকরণে ঘটনাস্থলে সিআইডি এবং পিবিআইয়ের বিশেষজ্ঞ টিমকে ডেকে আনা হয়। কিন্তু তার হাতের টিস্যু পচে যাওয়ার কারণে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
৮ জুন দুপুরে রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা গ্রামের দাউদ মার্কেটের পার্শ্ববর্তী ইদ্রিস আলীর কলাবাগান থেকে আইচগাতী ইউনিয়নের দেয়াড়া তেলির মোড় এলাকার ভ্যান চালক রবিউল মোল্লার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের শরীরে রয়েছে আঘাতের চিহ্ন। ভ্যান ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে দুর্বৃত্তরা হত্যা করতে পারে বলে ধারণা পুলিশের।
একই দিনে সকালে খুলনার রূপসা উপজেলার আইচগাতি উত্তর পাড়ায় শ্বাসরোধে সুমাইয়া খাতুন জান্নাত (২৩) নামে এক গৃহবধূ খুন হন। নিহত সুমাইয়া প্রবাসী শাওন শেখের স্ত্রী। গভীর রাতে কে বা কারা গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। ৪ জুন সকালে খুলনা সদর থানার মতিয়াখালী স্লুুইচগেট খালের মাথায় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির ভাসমান মরদেহ দেখতে পায় স্থানীয়রা। পরবর্তীতে নৌ-পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে। এর আগে ২ জুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে খুলনা মহানগরী সোনাডাঙ্গা থানাধীন ময়লাপোতা হরিজন কলোনীতে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে সবুজ হাওলাদার (৩০) নামে এক যুবক খুন হয়।
খুলনা সদর নৌ-পুলিশের অফিসার ইনচার্জ বাবুল আক্তার সোমবার রাতে বলেন, গত ৪ জুন অজ্ঞাত এক নারীর লাশ উদ্ধার ঘটনায় একজন এসে তাদের লাশ হিসেবে দাবি করছে। এর আগে ওই লাশের শরীর এবং হাতের আঙ্গুলগুলো পচন থাকায় প্রযুক্তি ব্যবহার করেও পরিচয় সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যার কারণে লাশটির ছবি তুলে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এখন যারা লাশের দাবি করছে তাদের ডিএন পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় সনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এছাড়া ১০ মে বিকেলে খুলনা মহানগরীর খানজাহান আলী থানাধীন ভৈরব নদের এ্যাজাক্স জুট মিল ঘাট থেকে অজ্ঞাত (৪০) এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১১ মে রাতে খুলনার খানজাহান আলী সেতু সংলগ্ন হিরনের ঘাট নামক স্থান থেকে অজ্ঞাতনামা (৪২) এক যুবকের ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। রূপসা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবুল খায়ের বলেন, রাত ৮ টার দিকে জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ থেকে ফোন করে জানানো হয়, খানজাহান আলী সেতুর পশ্চিম পাড়ে উত্তর পাশে একটি মরদেহ ভাসছে। তার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ৭ মে হরিণটানায় পারিবারিক কলহের জেরে স্বামীর মারধরে জান্নাতি আক্তার (২০) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। ২৩ মে ভোর ৫ টার দিকে নগরীর শিপইয়ার্ড মেইন রোড সংলগ্ন মোশারফের বাড়িতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞাত যুবকের লাশ দেখতে পেয়ে লবণচরা থানায় খবর দেয়। পরবর্তীতে লাশের পরিচয় পায় পুলিশ। মৃত ব্যক্তির নাম নাঈম মোল্লা।
২৬ মে রাতে রূপসা উপজেলার মোছাব্বরপুর গ্রামে দুর্বৃত্তের গুলিতে মো: রনি ওরফে কালো রনি (৩৬) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। একই দিন রাতে মহানগরীর সোনাডাঙ্গা ২২তলা এলাকায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে গোলাম (২৫) নামে এক যুবক নিহত হন। ১৭ মে দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে মীরেরডাঙ্গা খেয়াঘাট এলাকায় নদী থেকে ১৩ বছরের অজ্ঞাতনামা কিশোরের ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৯ মে বিকেলে খালিশপুর থানার ৬নং মাছ ঘাট এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার হয়। তার শরীরে নীল রংয়ের গেঞ্জি এবং কালো রংয়ের প্যান্ট ছিল। ওই ব্যক্তির মুুখ এবং হাতের আঙ্গুলের টিস্যু পচে যাওয়ার কারণে সিআইডি এবং পিবিআইয়ের বিশেষজ্ঞ টিম তার পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি। পরে তার শরীর থেকে ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। পরদিন সুরাতহাল রিপোর্ট এবং ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ আঞ্জুমান মফিদুলের মাধ্যমে দাফন করা হয়।
২৭ মে খুলনার কয়রা নদীর চর থেকে বাঁশের খুটির সাথে শিকলে তালাবদ্ধ অবস্থায় আব্দুল মজিদ সানা (৬০) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২২ মে খুলনা মহানগরীর টুটপাড়া দারোগার বস্তির পাশে একতলা ভবন থেকে নিলু বেগম (৫৬) নামের এক বৃদ্ধার ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। রাতের আধারে দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করে ঘরের মালামাল লুট করেছে বলে এলাকাবাসির ধারণা। ২৩ মে খুলনার রূপসায় স্ত্রীর পরকীয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবদার শেখ (৪৫) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে হত্যা করে স্বামী মনি শেখ। সে সময় স্ত্রী তানজিলাকেও কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। ৩১ মে খুলনা জেলার কয়রায় পারিবারিক কলহের জেরে ছোট ভাইকে হত্যা করে বড় ভাই। হত্যাকান্ডের ঘটনায় বড় ভাই শহীদুল গাজীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সার্বিক বিষয়ে কেএমপির সহকারি পুলিশ কমিশনার খোন্দকার হোসেন আহমদ ( মিডিয়া এন্ড সিপি) বলেন, খুলনা যে সমস্ত ঘটনা ঘটছে প্রত্যেক বিষয়ে ডিটেক্ট হচ্ছে এবং আসামি গ্রেফতার হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য শহরে টহল টিম কাজ করছে, সিটিএসবি কাজ করছে, পাশাপাশি ডিবি পুলিশও কাজ করছে। মানুষকে সচেতন করার জন্য সুধি সমাবেশ করছি আইন শৃঙ্খলা বিষয় নিয়ে। পরবর্তীতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button