স্থানীয় সংবাদ

নিয়ম লঙ্ঘন করে আগত দু’জনই এখন বোর্ড চেয়ারম্যান ও সচিব

# ‘নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট’’ #
# সংকটে ‘‘নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ভবিষৎত
# অনিশ্চয়তায় অধ্যয়নরতদের শিক্ষা জীবনও

স্টাফ রিপোর্টার ঃ খুলনার ‘‘নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট’’ নিয়ে অস্থিরতা চরমে পৌছেঁছে। নিয়ম বর্হিভূত নতুন ট্রাস্ট্রি সংযোজন, বোর্ড সভা আহবান, ফাউন্ডার ট্রাস্ট্রিদের বাদ রেখে সভায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এনিয়ে এমনিতেই অস্থিরতার মধ্যে নিমজ্জিত ‘‘নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট। তার ওপর নিয়ম লঙ্ঘন করে আগত দু’জনই এখন গোপন সভা করে বোর্ড অব ট্রাস্ট্রির চেয়ারম্যান ও সচিব বনে গেছেন। ফলে অস্থিরতা চরমে পৌছেঁছে। সংকটে পড়েছে ট্রাস্ট্রের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ‘‘নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ভবিষৎত। অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনও। সূত্রমতে, ৫ আগস্টের পর বোর্ড অব ট্রাস্টির যারা আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন তারা নিষ্ক্রিয়। এজন্য ২০২৪ সালের ২২ আগস্ট বোর্ডের ৬৬তম সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সিরাজুল হক চৌধুরীকে। চেয়ারম্যান ট্রাস্টি বোর্ডের শুন্য ৩টি পদে পছন্দের ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেন। কিন্তু বেশিরভাগ সদস্য এর বিরোধিতা করেন। তা স্বত্ত্বেও ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ৬৮তম সভায় মো: মিজানুর রহমান এবং ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৬৯ তম সভায় সৈয়দ হাফিজুর রহমানকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা মেমোরেন্ডাম অব এসোসিয়েশন এন্ড রুলস্ এন্ড রেগুলেশন এর ০২ ও ০৩ নং ধারা সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানা গেছে। এনিয়ে ১৫ ডিসেম্বর বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করা হয়, যার অনুলিপি শিক্ষা সচিব ও নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ভিসিকে দেয়া হয়। এই আবেদনের ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ না আসায় হাইকোর্টে রিট পিটিশন (নং ১৫৫২৮/২০২৪) করেন ভূক্তভোগী ৪ জন্য বোর্ড সদস্য। সূত্র জানায়, ‘‘নর্থ ওয়েষ্টার্ন ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট’’ এর ট্রাষ্ট্রি সদস্য সংযোজন ও বিয়োজন না করা প্রসঙ্গে ২০২৫ সালের ১২ জানুয়ারি চারজন্য ট্রাস্ট্রি যথাক্রমে তৌহিদুল ইসলাম আজাদ, সৈয়দ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, মর্জিনা ইসলাম ও মুজিবুর রহমান শামীম যৌথ স্বাক্ষরিত একটি আবেদন খুলনা যৌথ মূলধনী কোম্পানীজ এন্ড ফার্মস’র রেজিষ্ট্রার বরাবর জমা দেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর জারিকৃত ৭০ তম বোর্ড সভার নোটিশে ফাউন্ডার ট্রাস্ট্রি মর্জিনা ইসলামের নাম অন্তর্ভূক্ত থাকলেও তাকে সভার কোন নোটিশ প্রদান করা হয়নি। এছাড়া উচ্চ আদালতে রিট পিটিশনের কথা জানানো হয়।
সূত্র আরও জানায়, গত ২০ নভেম্বর বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ট্রাস্টি বোর্ডের উদ্যোক্তা সদস্য তৌহিদুল ইসলাম আজাদ, সৈয়দ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ ও পবিত্র কুমার সরকারকে বাদ দেওয়ার দাবিতে চেয়ারম্যানকে ঘেরাও করেন। দাবির মুখে সেদিনই ওই তিনজনকে সাময়িকভাবে কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার অফিস আদেশ জারি করেন চেয়ারম্যান। তবে ২০২৫ সালের ২৪ মে আরেকটি অফিস আদেশে চেয়ারম্যান জানান, ভিসির নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখিত তিন ট্রাস্ট্রির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২০ নভেম্বরের আদেশটি প্রত্যাহার করা হল। সুতরাং ট্রাষ্ট্রিগণ এখন থেকে নিয়মিত বিশ^বিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রমে অংশ নিবেন। পরদিন ২৫ মে অনুষ্ঠিত ৭৩ তম বোর্ড সভায় ৬৮তম সভার ৯ এর ১৭ নং ধারা (মিজানুর রহমানের নতুন ট্রাস্ট্রি সদস্য অন্তর্ভূক্তকরণ) সম্পূর্ণরূপে বাতিল ঘোষণার সাথে ৬৯, ৭০, ৭১ এবং ৭২ তম বোর্ড সভার বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলো বাতিল করা হয়। অপরদিকে, চলতি বছরের ২৬ মে নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার (চলতি দায়িত্ব) ড. সাহিদা খানম স্বাক্ষরিত পত্রে জানা যায়, ২১ মে ৭৩ তম ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় মোঃ মিজানুর রহমানকে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। এছাড়া ২১ মে ৭৩ তম বোর্ড সভার এক বিজ্ঞপ্তিতে সৈয়দ হাফিজুর রহমান ট্রাস্ট্রি ও বোর্ড সচিব হিসেবে স্বাক্ষর করে জানিয়েছেন, দুই বছরের জন্য মিজানুর রহমানকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চেয়ারম্যানসহ অধিকাংশ ফাউন্ডার ট্রাস্ট্রিদের অনুপস্থিতিতে ৭৩ তম ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় জুমে উপস্থিত ছিলেন বোর্ড সদস্য প্রফেসর ড. খন্দকার বজলুল হক, তার স্ত্রী সৈয়দা লুতফা হক, ড. মোঃ রেজাউল আলম, নাহিদ নেওয়াজী, সায়ের জে সাত্তার, প্রস্তাবিত নতুন সদস্য মোঃ মিজানুর রহমান ও সৈয়দ হাফিজুর রহমান।
বলা বাহুল্য, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টের ‘ডিড অব এ্যাগ্রিমেন্ট’ অনুযায়ী- ‘‘বোর্ড সদস্যদের সর্বসম্মতিতে নতুন সদস্য অন্তর্ভূক্ত হবে এবং নূন্যতম ৭ সদস্য’র উপস্থিতি কোরাম পূর্ণ হবে’’। সেখানে ৭৩ তম বোর্ড সভায় ছিলেন মাত্র ৪ জন- প্রফেসর ড. খন্দকার বজলুল হক, সৈয়দা লুতফা হক, ড. মোঃ রেজাউল আলম ও নাহিদ নেওয়াজী। এছাড়া উপস্থিত বাকি ৩ জন সায়ের জে সাত্তার, মোঃ মিজানুর রহমান ও সৈয়দ হাফিজুর রহমান ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হননি বলে সূত্রে নিশ্চিত করা গেছে। একদিকে যথাযথ নিয়ম মেনে ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য হননি, তা স্বত্তেও সভা করেছেন, অথচ কোরাম পূরণ হয়নি, আর সেই সভায় নিজেদের চেয়ারম্যান ও সচিব পদে অধিষ্ঠিত করেছেন মিজানুর রহমান ও হাফিজুর রহমান! যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-নিবন্ধক মো: রকিব আহমেদ রনী জানান, সোসাইটি আইনের আওতায় ‘নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট’ নিবন্ধিত। সুতরাং ট্রাস্টের ‘ডিড অব এ্যাগ্রিমেন্ট’ অনুযায়ী নতুন সদস্য অন্তর্ভূক্ত করতে হলে- সকল ট্রাস্ট্রির সর্বসম্মতিক্রমে অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতামতের ভিত্তিতে যেটা এ্যাগ্রিমেন্টে উল্লেখ আছে, সেই পন্থায় নতুন ট্রাস্ট্রি নাম অন্তর্ভূক্ত করে বোর্ড সভার রেজুলেশনসহ আরজেএসসি বরাবর সেটি রেকর্ড করার জন্য আবেদন করতে হবে।
রনী বলেন, আরজেএসসি’র নতুন ট্রাস্ট্রি রেকর্ড করার পূর্বশর্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ‘নিরাপত্তা ছাড়পত্র’। বোর্ড অব ট্রাস্ট্রির প্রদত্ত আবেদন পাবার পর গোয়েন্দা প্রতিবেদনের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তর (এনএসআই) বরাবর পাঠানো হয়। নিরাপত্তা ছাড়পত্র পাবার পরই আরজেএসসি ট্রাস্টের নতুন সদস্য হিসেবে রেকর্ডভূক্ত করবে, অন্যথায় নয়। বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক সুলতান মাহমুদ ভুইয়া (পিএইচডি) জানান, নিয়ম লঙ্ঘন করে ট্রাস্ট্রি বোর্ডের পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বিশ^বিদ্যালয় পরিচালনা করার সুযোগ নেই। অবশ্যই যথাযথ নিয়ম অনুসারে আরজেএসসি’তে ট্রাস্ট্রি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর এমন নানান অনিয়ম খতিয়ে দেখতে বদ্ধপরিকর বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। ক্ষেত্রবিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন এবং কমিটির সরেজমিন পরির্দশন শেষে প্রতিবেদন প্রদানের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অভিযোগ পেলে খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সিরাজুল হক চৌধুরী জানান, গত ২১ মে ২০২৫ তারিখে আমি লন্ডনে থাকা অবস্থায় আমাকে কিছু না জানিয়ে মিটিং করা হয়েছে। ওই মিটিংয়ে অধিকাংশ ট্রাস্টি উপস্থিত ছিলেন না। মূলত: শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সাবেক প্রফেসর ড. খন্দকার বজলুল হক এবং সাবেক এমপি এসএস কামালের ভগ্নিপতি ড. মোঃ রেজাউল আলম’র নেতৃত্বে মিজানুর রহমান ও হাফিজুর রহমানকে নিয়ে বিশ^বিদ্যালয়টি জবরদখল করে তথাকথিত ৭৩তম বোর্ড সভার নামে মিজানুর রহমানকে চেয়ারম্যান ও হাফিজুর রহমানকে সচিব ঘোষণা করা হয়।
তিনি আরও জানান, মিজানুর ও হাফিজুর ট্রাস্ট্রি বোর্ডের (জয়েন্ট স্টোক কর্তৃক নিবন্ধিত) কোন বৈধ সদস্য নন। তারা কি করে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান-সচিব হন? তারা এসব করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিলেন। বিভিন্ন আইনগত বাধার কারণে এতে বিপাকে পড়বেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। তবে এসব সংকট হতে পরিত্রাণ পেতে ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মো. মিজানুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে কতিপয় পদক্ষেপ নেই। তখন ওই সংকটে ড. মোহাম্মদ সিরাজুল হক চৌধুরী অনুপস্থিত থাকায় ক্ষুব্দ বোর্ড মেম্বাররা আমাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে অনুমোদনের জন্য আরজেএসসি ও ইউজিসিতে পত্র প্রেরণ করা হয়।
তিনি জানান, নানান আইনী জটিলতার কারণে আরজেএসসিতে ট্রাস্টি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে সময় লাগবে। এছাড়া আদালতের স্মরণাপন্ন হয়ে ডিড অব এ্যাগ্রিমেন্টের কয়েকটি ধারা সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে অসঙ্গতি দূর করতে হবে। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া বিশ^বিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ কাজ দ্রুত করার সাথে অর্থ আত্মসাৎ করার দায়ে অভিযুক্তদের ব্যাপারে আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে সৈয়দ হাফিজুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিশ^বিদ্যালয়টির সৃষ্টির অতিত ইতিহাস রয়েছে। খুলনার মানুষ চেয়ারম্যান হবে, সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেই মিজানুর রহমানকে দায়িত্ব অর্পণ করেন বোর্ড সদস্যরা। তবে অনুষ্ঠিত ওই বোর্ড সভায় উপস্থিতির মধ্যে তিনজন ট্রাস্ট্রি নন, সেখানে কিভাবে সভায় চেয়ারম্যান ও সচিব নির্ধারণ হলো? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে কোন সদুত্তর মেলেনি।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর খুলনার প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনুমোদন পায় নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি। ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য ছিলেন ১৮ জন। খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেসিসির সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন খুলনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসেন। বিশ^বিদ্যালয়ের অন্য ট্রাস্টিরা জানান, ১৮ জনের ট্রাস্টি বোর্ডে ৫ জন রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, সাবেক মেয়র ও সংসদ সদস্য।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button