স্থানীয় সংবাদ

‘খুলনা অচল’ কর্মসূচির হুমকি

দোসর বিরোধী ক্ষোভে উত্তাল খুলনা
পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগের এক দফা
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ছাত্র-জনতার ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম
ফের কেএমপি’র প্রধান ফটকে তালা

স্টাফ রিপোর্টার : এবার ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে মহানগরী খুলনা। শ্লোগান উঠেছে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দারের পদত্যাগের একদফা দাবির। এ জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দিয়েছে ছাত্র-জনতা।
এদিকে, ফ্যাসিবাদের দোসর এসআই সুকান্ত দাস গ্রেফতার হওয়ায় ছাত্র-জনতার এক দফা দাবি পূরণ হলেও প্রথম দফায় তাকে আটকের পর ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দারের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। এ দাবিতে বুধবারের ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবারও বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তর (কেএমপি) ঘেরাও করে ফের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এছাড়া মূল ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করা হয়।
সর্বশেষ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারীরা পুলিশ কমিশনার, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ঘোষণা করেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিশনারের পদত্যাগের দাবি পূরণ না হলে শনিবার দুপুর ১২টা থেকে খুলনা শহর অচল করে দেওয়ার কর্মসূচি পালন করা হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ব্যাপারে ছাত্র-জনতা অঙ্গীকারবদ্ধ বলে জানানো হয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা জানান, এস আই সুকান্তকে মারধর করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার পর ছেড়ে দেওয়ার প্রতিবাদে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দারের পদত্যাগের দাবিতে কেএমপি ঘেরাও করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে ছাত্র জনতা। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) বিকাল ৪টা থেকে খানজাহান আলী সড়কে কেএমপির সামনে এই অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। এসময় ছাত্র-জনতা কেএমপির সামনের সড়কে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। কেএমপির সামনে আন্দোলনকারীদের অবস্থানের কারণে রাস্তার দুইপাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
আন্দোলনকারীরা জানান, এসআই সুকান্ত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর নির্যাতন চালিয়েছে। সেই সুকান্তকে জনতা আটক করে পুলিশে সোপার্দ করে। অথচ তার নামে একাধিক মামলা থাকার পরও পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে। এ জন্য আমরা কেএমপি কমিশনারের পদত্যাগ চাই। পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। বিক্ষোভকারীরা ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’, ‘জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো’, ‘সুকান্তের চামড়া, তুলে নেব আমরা’, ‘পুলিশ কমিশনারের চামড়া, তুলে নেব আমরা’, ‘পুলিশ কমিশনার জুলফিকার, আস্ত একটা স্বৈরাচার’, ‘অবৈধ পুলিশ লীগ, মানি না, মানব না’, ‘লড়তে হবে, লড়তে হবে—এই লড়াই জিততে হবে’ স্লোগান দিতে থাকেন।
পুলিশের কাছে হস্তান্তরের পরও এস আই সুশান্ত দাশকে ছেড়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বুধবার দুপুর থেকে কেএমপি সদর দপ্তর ঘেরাও করে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এক পর্যায়ে তারা কেএমপি সদর দপ্তরের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। রাত সাড়ে ৯টায় ছাত্ররা চলে গেলে তালা ভেঙ্গে কার্যালয় থেকে বের হন পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে বৃহস্পতিবার বিকালে ফের কেএমপি ঘেরাও করে পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগের দাবি জানায় আন্দোলনকারীরা।
খুলনায় ছাত্র-জনতার আল্টিমেটাম, ‘শহর অচল’-এর হুমকি : খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দারের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে খুলনা। ‘জুলাই অভ্যুত্থানকারী ছাত্রজনতা’র ব্যানারে গত ২৫ জুন থেকে শুরু হওয়া অবস্থান কর্মসূচি তীব্র আকার ধারণ করেছে। একজন পুলিশ উপ-পরিদর্শককে (এসআই) গ্রেপ্তার করার পর ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই বিক্ষোভের সূত্রপাত হলেও, মূলত পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দাবি মানা না হলে শনিবার (২৯ জুন) দুপুর ১২টা থেকে ‘খুলনা অচল’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ‘বিপ্লবী ছাত্র জনতা, খুলনা’র পক্ষ থেকে প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্প্রতি এসআই সুকান্ত নামের এক পুলিশ কর্মকর্তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, এসআই সুকান্ত “পুলিশলীগের মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল, বহু অপকর্মের হোতা এবং চার মামলার আসামি”। কিন্তু তাকে রাতের আঁধারে ছেড়ে দেওয়া হয়, যা পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দারের নির্দেশেই ঘটেছে বলে তারা দাবি করেন। এই ঘটনাকে তারা কমিশনারের “অপকর্মের কফিনে শেষ পেরেক” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, জুলফিকার আলী হায়দার কেএমপি কমিশনার হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে খুলনার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “গত চার মাসে খুলনাবাসী অন্তত তিন ডজন হত্যাকা- প্রত্যক্ষ করেছে।” তারা আরও অভিযোগ করেন, কমিশনার “খুলনার সকল সন্ত্রাসী ও লীগারদের ত্রাতা” হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অপরাধীরা তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে শহরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আন্দোলনকারীদের দাবি, পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার শুরু থেকেই জুলাই অভ্যুত্থানকারী ছাত্রজনতার প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখিয়েছেন এবং তাদের সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের আরও অভিযোগ, বিভিন্ন থানা থেকে আটক চিহ্নিত আসামিদের ছেড়ে দেওয়া, অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা না নেওয়া এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার নিরুৎসাহিত করতে কমিশনার সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। এছাড়া, অযোগ্য ও দলীয় বিবেচনায় বিভিন্ন থানার ওসি এবং কেএমপির গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মকর্তা পদায়নের অভিযোগও তোলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
কর্মসূচি ও আল্টিমেটাম: বিপ্লবী ছাত্র জনতার ব্যানারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারীরা পুলিশ কমিশনার, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ঘোষণা করেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিশনারের পদত্যাগের দাবি পূরণ না হলে শনিবার দুপুর ১২টা থেকে খুলনা শহর অচল করে দেওয়ার কর্মসূচি পালন করা হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ব্যাপারে ছাত্র-জনতা অঙ্গীকারবদ্ধ বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে খুলনার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। গোটা খুলনা জুড়ে এখন টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে খানজাহান আলী থানা এলাকা থেকে স্থানীয়রা মারধর করে উপ-পরিদর্শক সুকান্তকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। তিনি বর্তমানে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানায় কর্মরত আছেন। আদালতে একটি মামলার সাক্ষী দিতে খুলনায় এসেছিলেন তিনি। তার নামে খুলনা সদর থানায় ছাত্র-জনতার উপর হামলার ঘটনায় গত ১২ ডিসেম্বর মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি বর্তমানে ডিবিতে তদন্তাধীন। এছাড়া বিএনপির নগর সভাপতি শফিকুল আলম মনার বাড়ি ভাঙচুরসহ দুটি মামলা চলমান রয়েছে।
এদিকে, এস আই সুকান্তকে ছেড়ে দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এর প্রতিবাদে বুধবার সকালেই তারা কেএমপি ভবন ঘেরাও করার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সে মোতাবেক বেলা ১২টার পর থেকেই নগরীর গ্লাক্সোর মোড়স্থ কেএমপি ভবনের প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এক পর্যায়ে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে এবং অবস্থানের কারণে সামনের খানজাহান আলী সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা নিষিদ্ধ আওয়ামী ফ্যাসিবাদেও দোসরদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দেন। আন্দোলন-বিক্ষোভে কেএমপি ভবনে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা এক প্রকার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এ আন্দোলনে বিএনপি, এনসিপি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও ছাত্র-জনতা অংশ নেয়। এভাবে একটানা প্রায় ১০ ঘন্টা বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিক্ষোভকারীরা অবরোধ তুলে নেন।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button