
মূলহোতা আটক, গডফাদাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরে
কামরুল হোসেন মনি : খুলনায় বিষাক্ত মদপানে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় বিষাক্ত মদ তৈরির মুলহোতা হ্যানিমান হোমিও ফার্মেসী ও শিশু মাতৃমঙ্গলের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত শেখ মোসলেম আলি (৭৮) নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করেছেন। বিষাক্ত মদপানে মৃত ব্যক্তিরা হচ্ছে তোতা মিয়া (৬০), গৌতম (৪৮), সাহাবুদ্দিন সাবু (৬০), আফরোজ হোসেন বাবু (৪৮), সাজ্জাদ (৪০) এবং রাসেল সরদার (৩৬)। এর মধ্যে রাসেল সরদার রোববার (২০ জুলাই) খুলনা বেসরকারি গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার লাশ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রোবরাবর দুপুরে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার ( দক্ষিণ) মো: আবু তারেক। তিনি বলেন, এর আগের দিন বিষাক্ত মদপানে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়। রোববার দুপুরে রাসেল সরদার নামে আরও এক ব্যক্তি গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার থুকড়া এলাকায়।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মো: আবু তারেক আরও জানান, হ্যানিমান হোমিও ফার্মেসী ও শিশু মাতৃমঙ্গল চিকিৎসার আড়ালের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত শেখ মোসলেম আলি দীর্ঘদিন ধরে এলকোলি নামের মাদক, ঘুমের ওষুধ ও চুনের পানি দিয়ে ঘরে বসে মদ তৈরি করতেন। যা চিকিৎসকের ভাষায় বিষাক্ত মদ। আড়ংঘাটা থানার পূর্ব বিল পাবলা মদিনা নগর এলাকার একটি ঘেরে বসে কয়েকজন সেই মদ পান করেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার রাতে একজন এবং শনিবার আরও ৪ জন মারা যান। রাতে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত মদ বিক্রেতাকে আটক করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত মোসলেম আলী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রিজন সেলে পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া তার তৈরি মদপানে রাসেল সরদার নামে আরও একজন ব্যক্তি গাজী মেডিকেল হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃত ব্যক্তির মধ্যে খুলনা মহানগরী বয়রা বাসিন্দা ৪ জন, পিরোজপুরের একজন এবং ডুমুরিয়ার একজন বাসিন্দা রয়েছে।
খুলনা সোনাডাঙ্গা মডেল থানা এসআই আব্দুল হাই জানান, বিষাক্ত মদপানে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় । এর মধ্যে মৃত তোতা মিয়ার স্থায়ী বাড়ি পিরোজপুর এলাকায় সে মৃত; জবেদ আলী ফকিরের পুত্র। তিনি নগরীর পাবলিক কলেজের ২য় গেটের পাশে বসাবস করতেন। এছাড়া মৃত গৌতম এর স্থায়ী বাড়ি দাকোপ উপজেলার চালনা গ্রামে। সে কালিপদ বিশ্বাসের পুত্র। সেও খালিশপুর এলাকায় অস্থায়ীভাবে বসাবস করতো। মৃত সাহাবুদ্দিন সাবু নগরীর বয়রা শেরের মোড় ইসলামিয়া কলেজের পেছনে মৃত সামাদ মোল্লার পুত্র, আফরোজ হোসেন বাবু বয়রা মধ্যপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রউফ এর পুত্র এবং সাজ্জাদ মল্লিক হরিনটানা থানাধীন রায়ের মহল মল্লিক বাড়ি গ্রামের বাসিন্দা মৃত আক্তার মল্লিকের ছেলে।
এদিকে খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ‘খ’ সার্কেলের পরিদর্শক মো: ফরহাদ হোসেন বলেন, সার্কেলের মহানগরীতে দুইটি ও উপজেলায় ফুলতলায় একটি দেশী মদের দোকানের লাইসেন্স আছে। এছাড়া (আরএস) রেক্ট্রিফাইড স্পিড বিক্রির একজন রয়েছেন খালিশপুর হোমিও ল্যাবের।
‘ক’ সার্কেলের পরিদর্শক মো: আব্দুর রহমান বলেন, তার সার্কেলের দেশি মদের লাইসেন্সধারী দোকান রয়েছে দুটি এবং উপজেলা দাকোপে রয়েছে একটি। এছাড়া বিলাতী মদ বিক্রির লাইসেন্স রয়েছে দুইটি। এর মধ্যে খুলনায় ফেরিঘাট এলাকায় ১টি এবং খুলনা ক্লাবের নামে লাইসেন্স রয়েছে। র্যাক্টিফাইড (আরএস) লাইসেন্স রয়েছে হ্যানিম্যানের।
খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: মিজানুর রহমান বলেন, খুলনায় অবৈধভাবে বিষাক্ত মদ তৈরি করছেন এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। পত্র-পত্রিকায় মাধ্যমে জানতে পেরেছি বিষাক্ত মদ পানে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। অবৈধ মদ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
খুলনা সচেতন মহলের অভিযোগ পুলিশ, র্যাব, ডিবি পুলিশসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন অভিযানে ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাজাসহ বিভিন্ন মাদকসহ মাদক বিক্রেতাকে আটক করা হলেও এর পেছনে মাদকের গডফাদার থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত ২১ মে রাতে লবনচরা থানা পুলিশ বিশ^ রোড সাচিবুনিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি গাজাসহ মাদক ব্যবসায়ী মহিলাসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় লবনচরা থানায় ৪ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলার মাদকদ্রব্য ক্রয় বিক্রয়ে পৃষ্টপোষকতা এবং অর্থযোগান পলাতক আসামি গাজার চালানের মূল মালিক ছিলো রাসেল (৪২)। সে নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন ময়লাপোতার ( সন্ধ্যা বিপরীত পাশে) বাসিন্দা মৃত নাসিম উদ্দিনের ছেলে। তার বাবা একজন চিকিৎসক ছিলেন বলে পুুলিশ সূত্রে জানা যায়। মামলার এজাহারের উল্লেখ করা হয়, ৩নং আসামি মো: আনোয়ার হোসেন সোহাগ জানায়, তার হেফাজত হতে জব্দকৃত ২ কেজি গাজার মালিক, অর্থযোগানদাতা এবং মাদকদ্রব্য গাজা ক্রয়-বিক্রয় ৪নং পলাতক আসামি রাসেল (৪২)। ধৃত আসামি এবং পলাতক আসামি অবৈধ মাদক বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে নিজ হেফাজতে রেখে এবং মাদকদ্রব্য ক্রয়/বিক্রয় এবং মাদকদ্রব্য ক্রয় বিক্রয় পৃষ্টপোষকতা এবং অর্থযোগান দিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে অপরাধ করেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, পলাতক রাসেল নগরীতে প্রকাশ্য চলাফেলা করলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি তা একটা বড় উদাহরণ বলে সচেতন মহলের দাবি। খুলনায় কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সাথে মাদকদ্রব্য ক্রয়/বিক্রয় এবং মাদকদ্রব্য ক্রয় বিক্রয় পৃষ্টপোষকতা এবং অর্থযোগান পলাতক আসামি রাসেলের সাথে সখ্যতা থাকায় সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ ব্যাপারে কেএমপির সহকারি পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) খন্দকর হোসেন আহমেদ বলেন, কেএমপির থানাধীন কোন মাদকের গডফাদারের সাথে পুলিশের সখ্যতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর বিষাক্ত মদপানে খুলনায় ৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ২০২০ সালের ৪ মে খুলনায় বিষাক্ত মদপানে দুজনের মৃত্যু হয়েছিল। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি খুলনা মহানগরীতে অ্যালকোহল পানে এক যুবকের মৃত্যু হয়। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছিল।