খুলনা অশান্তের মহানায়ক ফ্যাসিস্ট এস এম কামাল অধরা নির্বাচনে মডেল কারচুপির উদ্যোক্তাও তিনি

স্টাফ রিপোর্টার ঃ ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতা, তার উপর দলের শীর্ষ নেতাদের সুদৃষ্টি, শেখ পরিবারের ঘনিষ্টজন। তাই খুলনায় অনেকটাই প্রভাবশালী ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা এসএম কামাল হোসেন। তার ক্ষমতা ও দাপটের অনেকেই ছিলেন অসহায়। শুধু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলই নয়, পোড় খাওয়া অনেক আওয়ামী লীগ নেতারাও নাস্তাবুদ হতেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামালে। ভৈরবের তীর ঘেঁষা খালিশপুর, দৌলতপুর ও খানজাহান আলী থানা এলাকা নিয়ে গঠিত খুলনা-৩ আসন। শিল্পাঞ্চলখ্যাত এলাকা হিসেবে পরিচিত এই আসনটি। এই আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন প্রথম সংসদ নির্বাচিত হন। এর আগে দলের রাজশাহী বিভাগে দায়িত্ব পালনকারী আওয়ামী লীগের এই সাংগঠনিক সম্পাদকের বিরুদ্ধে রয়েছে ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে মনোনয়ন বাণিজ্য, কমিটি গঠনের নামে সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। সদ্য সাবেক খুলনা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসেনের বার্ষিক আয় খাতা-কলমে ৪৭ লাখ টাকা হলেও বাস্তবে আরো বেশী। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে ঝামেলাহীন মডেল কারচুপির উদ্যোক্তাও এই সাংগঠনিক সম্পাদক। অভিযোগ রয়েছে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শান্ত খুলনাকে অশান্ত হয়েছিল এই নেতার কুপরামর্শে আর ক্ষমতার দম্ভে। অথচ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছরেও অধরা সেই এস এম কামাল হোসেন। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সাবেক সংসদ এস এম কামাল হোসেন ৯০’র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ছাত্রনেতা হিসেবে খুলনায় পরিচিত পান। এক সময়ে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন রাজনীতির সুবাদে অল্পদিনেই দলীয় প্রধানসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের নজরে আসেন। ফলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি সদস্য থেকে সহজেই সাংগঠনিক সম্পাদক হন। কেন্দ্রের ভারী পদ-পদবী ও দলীয় প্রধানের সুদৃষ্টির কারণে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। রাজশাহী বিভাগের দায়িত্ব পেয়ে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে এই নেতার বিরুদ্ধে। সেখানকার এক ক্ষুদ্ধ আওয়ামী লীগ কর্মী দলটির একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে লিখেছেন, ‘কামাল ভাই আপনি এই গ্রুপেই আছেন। এক সাধরণ মজুমদারের অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে আর জলিল সাহেবের কাছে আপনার ব্যক্তিগত ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে নওগাঁ আওয়ামী লীগ আপনি ধ্বংস করে দিয়েছেন। শুধু নওগাঁ কেন রাজশাহী বিভাগ আপনার লোলুপ দৃষ্টিতে তছনছ হয়ে গেছে। কিন্তু নিদারুণ সত্য কি জানেন মি: কামাল ভাই, এই আমাদের মতো দুঃসময়ের ছাত্রনেতাদের আপনি কমিটি থেকে বাদ দিয়েছেন আজ এই সংকটে আমরাই নওগাঁর আওয়ামী লীগকে ধরে রেখেছি, নেতাকর্মীদের পাশে আছি। আপনার দাদা সাধরণ, ভাতিজা জন কিংবা পেয়ারা এমপি মন্ত্রীরা কেউ কোন কর্মীর খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি। আপনাকে রাজশাহী বিভাগের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আজীবন অভিশাপ দেবে এবং নব্য খন্দকার মুশতাক হিসাবেই ডাকবে। কিংবা ক্যাশ কামাল বলেই ডাকবে। তবুও ভালো থাকবেন আর সময় হলে উত্তরবঙ্গ আসবেন।’ অবশ্য রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও ‘শেখ পরিবার’র ঘনিষ্টজন হিসেবে খুলনা বিভাগেও তার দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা, পৌরসভা, জেলা মনোনয়ন প্রদানে প্রভাব বিস্তার করতেন এসএম কামাল হোসেন। এজন্য বড় অংকের ‘ক্যাশ’ উপঢৌকন দিতে হতো এই নেতাকে। প্রভাব বিস্তার করতে দলের জেলা ও মহানগর শীর্ষনেতাদের সিদ্ধান্তেও। আর এভাবেই অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন এস এম কামাল। অবশ্য দ্বাদশ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামার তথ্য বলছে, কামাল হোসেনের বার্ষিক আয় ৪৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে ব্যবসা থেকে বছরে ২৮ লাখ ৯ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং এফডিআর ও ব্যাংক থেকে লভ্যাংশ পান ১৬ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় বছরে (ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী) ৩০ লাখ ৫ হাজার টাকা। কামাল হোসেনের সম্পদ রয়েছে মোট ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার। এর মধ্যে ২০ লাখ ১৭ হাজার নগদ টাকা, ব্যাংকে জমা ২৮ লাখ ৬৩ হাজার টাকা, ৩ কোটি ৪৫ লাখ স্থায়ী আমানত, ২০ লাখ টাকা মূল্যের একটি গাড়ি, গৃহস্থালী দ্রব্য এবং ব্যবসার মূলধন ৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। এছাড়া স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৮১ দশমিক ৮৪ ডেসিমেল কৃষি জমি, ৩ কাঠা অকৃষি জমি এবং ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা দামের একটি দোকান রয়েছে। কামাল হোসেনের স্ত্রী শিক্ষকতা পেশায় জড়িত। তার সম্পদ রয়েছে ৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকার। এর মধ্যে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্লাট, ৩৫ লাখ ২৮ হাজার নগদ টাকা, ব্যাংক জমা ২৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, ১ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে। তার ছেলে-মেয়ের যৌথ নামে একটি ফ্লাট ছাড়াও তাদের ৭৭ লাখ ৪২ হাজার টাকার সম্পদ রয়েছে। তবে বাস্তবে তাঁর সম্পদ আরো বেশী বলে ঘনিষ্টজনরা মন্তব্য করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের একাধিক বারের সংসদ সদস্য বেগম মন্নুজান সুফিয়ানও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও শেষ মুহূর্তে নিশ্চিত মনোনয়ন বঞ্চিত হন এস এম কামালের কৌশলে। পরবর্তীতে বেগম সুফিয়ানের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার সুযোগেও বাগড়া দেন এই নেতা। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৮ সালে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘নীরব ভোট কারচুপির নকশাকার’ এস এম কামাল হোসেন। কোন ধরণের সহিংসতা ছাড়া প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী, নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে ভোট কারচুপির নতুন অধ্যায়ের সুচনা হয় খুলনায়। সাথে ছিলেন খুলনা চেম্বারের একনায়কতন্ত্রের জনক কাজী আমিন। এই ভোটের পরাজিত একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে দৈনিক প্রবাহ। তারা জানান, ওই নির্বাচনে কারচুপি হবে তারা ভাবতে পারেননি। সবকিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু কৌশল করে এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ভোটার ঠিকই ছিল, সবই ওই পক্ষের। প্রশাসনকে অভিযোগ দিলেও তারা গা লাগাননি। অর্থাৎ উপরে উপরে সুষ্ঠু ভোট, ভিতরে দলের ছিল ভোট। এই প্রার্থীরা আরো জানান, কয়েকটি কেন্দ্রে ২/৩ ঘন্টা সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। বাকীগুলো ছিল বিক্রি হওয়া। তারপরও নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মাত্র এক লাখের মতো ভোটে হেরে যান। অথচ সুষ্ঠু ভোট হলে ফল হতো উল্টো। আর এই ভোট কৌশলের নায়ক ছিলেন এস এম কামাল হোসেন। পরবর্তীদের দেশের বিভিন্ন স্থানেই এই স্টাইলে ভোট হয়। তার সহযোগি হিসেবে কাজ করতো সাবেক কাউন্সিলর নিহত টিপু, আ’লীগ নেতা ইমরুল, বাশার, শহিদুলসহ আরো অনেকে। এদিকে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শান্ত খুলনাকে অশান্ত কতে তোলেন আওয়ামী লীগের এই কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক। মধ্য জুলাই থেকে ১ আগস্ট খুলনায় ছাত্রদের আন্দোলন ছিল অহিংস। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। অথচ এইদিন ১ আগস্ট রাতে আকষ্মিকভাবে খুলনার ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অভিভাবকদের সার্কিট হাউজে ডেকে আসেন এস এম কামাল হোসেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ও প্রশাসনের উপস্থিতিতে তিনি ছাত্রদের আন্দোলন প্রত্যাহারে চাপ দেন। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রকাশে গালিগালাজ, গুলি করে হত্যা ও গুম করার হুমকি দেন। এক পর্যায়ে চাপের মুখে খুলনার ছয় সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। পরদিন ২ আগস্ট প্রথম খুলনায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। পরবর্তীতে সহিংসতায় শত শত শিক্ষার্থী আহত হন। যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। পুলিশের গুলিতে চোখ হারাতে বসেছেন খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটির ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (ইইই) প্রথম বর্ষের ছাত্র আব্দুল্লাহ শাফিল। ২ আগস্ট খুলনায় পুলিশের গুলিতে শাফিলের বাম চোখ গুরুতর আহত হন। সার্কিট হাউজের সভায় উপস্থিত থাকা কমপক্ষে দুইজন সমন্বয়ক ও তাদের অভিভাবদের সঙ্গে কথা বলেছে । সমন্বয়করা বলেন, কামাল সাহেব আমাদের অভিভাবক ও প্রশাসনের সামনে টেবিল চাপড়ে হুমকি দেন। গুলি করে হত্যার কথা বলেন। অথচ প্রশাসন একটি কথাও বলেননি। স্থানীয়রা নেতারও চুপ ছিলেন। তাই বাধ্য হয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ছাত্রদের অভিভাবক ও পেশায় আইনজীবী বলেন, ৫ আগস্টে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন না হলে আজ আমি ও আমার সন্তান বেঁচে থাকতাম কিনা জানি না। টেবিলে থাপ্পড় মেরে আমাকে হুমকি ও গালি দেওয়া হয়। এখনও ভাবতে পারিনা। কী দুর্বিষহ, কী ক্ষমতা ও দম্ভ! ওই ঘটনা না হলে খুলনায় কিছু হতো না। আমরা চাই না এমন দানব আর ফিরে আসুক। আগস্টে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত এক উর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ১ আগস্ট পর্যন্ত খুলনা শান্ত ছিল। খুলনার নেতারা কোন চাপ দেয়নি। কিন্তু সার্কিট হাউজে কামাল সাহেবের হুমকি, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর অব্যাহত চাপে ছাত্র আন্দোলনে বল প্রয়োগ করা হয়- যা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের সিদ্ধান্ত ছাত্ররা আন্দোলন করবে করুক। ওরা মিছিল-সমাবেশ করে চলে যাবে। বলপ্রয়োগ করলেও সহিংসতা হবে। তাই আমরা বলপ্রয়োগে রাজি ছিলাম না। এ ঘটনার দায় অবশ্যই কামাল সাহেবের।