স্থানীয় সংবাদ

কেসিসির ছায়া মেয়র গোপালের টাকা তৈরীর কারখানা ছিল নগরভবন

# নামে বেনামে গড়ে তুলেছে অঢেল সম্পদ #

খলিলুর রহমান সুমন ঃ খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) ছায়া মেয়র ছিলেন স্বঘোষিত এপিএস গোপাল চন্দ্র সাহা। নগরভবনকে পুঁজি করে তিনি বনে গেছেন কোটিপতি। নগরীতে গড়ে তুলেছে বহুতলা ভবন। নিজ নামে করা হোল্ডিং-এর ঠিকানা হলো-গগণবাবু রোড দ্বিতীয়গলি, হোল্ডিং নং-২। নামে বেনামে করেছেন বহু সম্পদ। কেসিসি কোন কর্মচারি না হলেও তিনি ছিলেন অধিকাংশ নীতি নির্ধারক। নিয়মিত তিনি নগরভবনে নিজস্ব রুম ও ছিল তার চেয়ার। নিয়মিত তিনি অন্য কর্মচারির মত মেয়রের নিকট ফাইল উপস্থাপন করতেন। কেসিসি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের টাকা দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন অট্টালিকা। নির্দিষ্ট কোন কর্ম না থাকলে বিলাশ বহুল জীবন যাপন ছিল তার। কর্মচারি না হয়েও কেসিসি গাড়ি নিয়মিত ব্যবহার করতেন। এমন কি তিনি কেসিসির ঢাকার অফিসে স্টাফের মত বসবাস করতেন। ঢাকায় অবস্থানকালে কেসিসি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা তাকে বড় বড় মাছ, মধুসহ প্রিয় সব জিনিসই পৌচ্ছে দিতেন। ছায়া মেয়রের মত তিনি কেসিসি সকল কর্মকর্তা-কর্মচারিকে নির্দেশনা করতেন। নিয়ন্ত্রণও করতেন। কেউ তার নির্দেশনার বাইরে গেলেই নেমে আসতো নানা নির্যাতন। কেসিসির এমন কোন সেক্টর ছিল না যেখানে তিনি প্রভাব বিস্তার করে ভাগা নিয়েছেন। এমন কি সাবেক ৪১ জন কাউন্সিলর অধিকাংশই তাকে ভাগ দিয়ে নানা ধরণের কাজ ভাগিয়ে নিতে হতো। ঠিকাদারদের ফাইল তার অনুমতি ছাড়া পাশ হতো না। এ জন্য তিনি ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অংকের ভাগা নিতেন। অধিকাংশ ঠিকাদার তার কাছে ছিল জিম্মি। হিসাব শাখার ক্যাশিয়ার রনি ছিল তার খুবই কাছের লোক। ইচ্ছামত তিনি ক্যাশ থেকে নগদ টাকা নিতেন। যার জন্য ক্যাশিয়ার সঞ্চিব কুমার রনি মেয়রের আমলে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন না। এছাড়া এই রনি জেলা যুবলীগের সভাপতি পলাশের সাথে ঘুরে বেড়াতেন। এখন ভোল পাল্টিয়ে তিনি অন্য দলের ঘাড়ে উঠতে চেষ্টা করছেন। এই গোপালের খপ্পড়ে পড়ে আরো একজন ক্যাশিয়ার দেউলিয়া হয়ে গেছেন। আছেন এখন সাসপেন্ডে। রাজবাধে চার/পাঁচটি শুকুর পালনের গ্রুপ ছিল। প্রতিটি গ্রুপ রাজবাধে ময়লা স্তুপে শুকর রাখা বাবদ প্রতি মাসে দু’লাখ টাকা করে দিত। তার কথা যে শুনবে না সেই শুকরের দলকে রাজবাধে থাকতে পারতো না। এমন একজনকে কথা না শুনার দায়ে তাকে মিথ্যা মামলায় জেল খাটায় এই গোপাল ও তার চক্র। ওই ব্যক্তির বাড়ি ছিল তেরখাদায়। এ ঘটনায় গোপালের আস্থাভাজন নিরাপত্তা প্রহরী হাবিব ছিল সব কাজের সহযোগি। এই হাবিব একজন নির্বাপত্তা প্রহরী হলেও গোপালের চেষ্টা হন সহকারি নিরাপত্তা সুপার। তার বিনিময়ে এই হাবিব তাকে শলুয়ার পুকুরের সব মাছ বিক্রি করে টাকা এনে দিত। আর বটিয়াঘাটার পুটিমারি জমি ও মাছ সব গোপালকে এনে দিত। এ জন্য সহযোগিতা করতো আরেক ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর ধার্য শাখার সাবেক কর্মচারি শামীমুর রহমান। এছাড়া তার আরেক ক্যাশিয়ার ছিলেন সাবেক এষ্টেট অফিসার মোঃ নুরুজ্জামান তালুকদার। মাঠ পর্যায় থেকে সবাই তারই নির্দেশনায় টাকা এনে দিত আর সেই টাকা দিয়ে তিনি গোপালকে তুষ্ট করতেন। গোপাল মেয়রের এপিএস পরিচয় দিতে পারায় তিনি ছিলেন বেপরোয়া। সাবেক মেয়র তালুকদার আঃ খালেক প্রথম মেয়র হওয়ার পর এপিএস গোপাল নিয়োগ বাণিজ্য করায় সাবেক সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর সাহিদা বেগম তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করে। পরে গোপাল তার বাহিনী দিয়ে ওই কাউন্সিলর ও তার লোকদের নানাভাবে নাজেহাল করে। মাঝে মধ্যে তিনি ডুমুরিয়ার খর্নিয়া গিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতেন। তার সহায়তা করতেন সাবেক লাইসেন্স অফিসার (যান) রবিউল আলম। কাকে বদলী করা হবে আর কাকে বিনাকাজে রাখা যাবে-তা নির্ধারণ করতেন গোপাল। নগরভবনের মেয়র দপ্তরে তার জন্য প্রস্তুতকৃত আলাদা রুমে তদবির বাণিজ্যে মেতে উঠতেন। বিভিন্ন জায়গায় মেয়রের এপিএস পরিচয় দিতে মোবাইল করে বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করতেন। নগরভবনের মেয়র দপ্তরের একটি চক্রের সহায়তা তিনি বিলাশবহুলভাবে জীবন যাপন করতেন। তিনি যদিই দামি খাবার চাইতেন তাৎক্ষতি এ চক্রটি তা যোগাড় করে দিতেন। ৫ আগস্টের পর চক্রটি বোল পাল্টিয়ে স্ব স্ব চেয়ারে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। কেসিসির অধিকাংশ অফিসাররা তাদের মাসোহারা গোপালের হাতে সরাসরি না দিয়ে এ চক্রের কাছে দিতেন। এ চক্র সময় সুযোগ মত ওই টাকা গোপালের নিকট পৌচ্ছে দিতেন। মেয়র ক্ষমতায় থাকাকালিন সংবাদপত্রে গোপাল শিরোনামে আসে। ওই সময় লেখা হয়েছিল,“গোপাল জ্বরে কাপছে নগরভবন।” আরো একবার লেখা হয় “নগরভবনে দুর্নীতির মা গোপাল।” এতে সাবেক মেয়র ক্ষুব্দ হয়ে তাকে বকাঝকা করলেও কিছু দিন পরে আবারো স্ব চেয়ারে ফিরতেন গোপাল। একজন উপ-সহকারি প্রকৌশলী কেসিসির ডিউটি না করে সারা দিন গোপালের সেবায় ব্যস্ত সময় পার করতেন। এমন কি গোপালের নির্মানাধীন বাড়ির কাজের দেখভাল করতেন ওই উপ-সহকারি প্রকৌশলী। যদি তিনি এখন ভোল পাল্টিয়ে বিএনপি সাজতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পুরো কেসিসি ছিল এই গোপালের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে কনজারভেন্সী বিভাগে কর্মরত শামীমুর রহমান কেসিসির বটিয়াঘাটার পুটিমারীর সম্পত্তি লুটপাট করে খেতেন। গোপালকে সাথে নিয়ে তিনি এ কাজটি করতেন। যার জন্য বিষয়টি সবাই জানলেও গোপালের ভয়ে টু শব্দটি করতেন না। ৪ ও ৫নং ঘাট এলাকায়ও ছিল তার আনন্দ ফুর্তির করার নির্ধারিত স্থান। এ জন্য সহায়তা করতো সাবেক এক কাউন্সিলর। এই গোপালের আরেক সহযোগির নাম রিয়াজ। এই রিয়াজ খুলনার হার্ডমেটাল গ্যালারীতে ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা করলেও গোপালের মাধ্যমে মেয়রের সানিধ্যে আসনে। তিনি নিয়মিত মেয়রের পছন্দের খাবার নিয়ে আসতেন আর বিভিন্ন জায়গায় গোপালের সহযোগিতায় জমি ও বাড়ি দখলের চেষ্টা করতেন। সাধারণ মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানী ছিল তার কাছ। এ জন্য গোপাল তাকে সহায়তা করতো। তবে যারা তার অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন তারা বাধ্য হয়ে এ কাজ করেছেন বলে সবাই জানান। কেসিসি কর্মচারি ইউনিয়নের সভাপতি উজ্জল কুমার সাহা বলেন, সাবেক মেয়র তালুকদার খালেকের প্রথম সময় গোপাল এপিএস হলেও পরবর্তী দু’বার আর হতে পারেননি। কিন্তু তিনি ওই নাম ব্যবহার করে নানা ধরণের তদ্বির বাণিজ্য করতেন। একজন বহিরাগত লোক হয়ে মেয়র দপ্তরে নির্ধারিত রুম আর ছিল চেয়ার ও টেলিফোনের ব্যবস্থা। মেয়র দপ্তরের একটি চক্র গোপালের এসব অনৈতিক কাজে সহায়তা করতো। মেয়রের নাম ভাঙ্গিয়ে এই গোপাল নগরীতে গড়ে তুলেছেন অট্টালিকা। নামে বেনামে গড়ে তুলেছে অঢেল সম্পদ। ৫ আগস্টের পর তার এ অনিয়মের বিচার হওয়া উচিত। তার অপকর্ম তদন্ত সাপেক্ষে কেসিসি কর্তৃপক্ষ তাকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। কেসিসির উপ-সহকারি প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সেলিমুল আজাদ বলেন, মেয়র আঃ খালেকের আমলে গোপাল বেপরোয়া আচরণ করতেন। তিনি কাউকে মানুষ ভাবতেন না। যার তার সাথে দুর্ব্যবহার করতেন। মেয়রকে সামনে রেখে তিনি পিছনে থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। কর্মচারি বদলী, পদোন্নতি, বহিস্কার বাণিজ্য ছিল তার হাতে। তিনি বহিরাগত মানুষ হয়ে কেসিসির পুকুর, ঘের, চাষাবাদের জমি, ফসল ছায়া মেয়রের মত নিয়ন্ত্রণ করতেন। ঢাকা অফিস কেসিসির স্টাফের মত ব্যবহার করতেন। নগরভবনের চেয়ার টেবিল, রুম, টেলিফোন ব্যবহার ও নথি উপস্থান কোন আইনে করতেন তা জানা নেই। এসব অন্যায় কর্মকান্ডের ন্যুনতম বিচার হওয়া উচিত বলে তিনি জানান। কেসিসি সচিব ( ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) শরীফ আসিফ রহমান বলেন, বিষয়গুলো তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান। তবে গোপাল চন্দ্র সাহার সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button