খুলনা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সাইফুল গংদের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকা আতœসাতের অভিযোগ

# বিশেষ সাধারণ সভায় অডিট রিপোর্টে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ #
স্টাফ রিপোর্টারঃ বিগত পাঁচ বছরে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির প্রায় ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এ অনিয়ম ও টাকা আত্মসাতের সাথে জড়িত সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. মো. সাইফুল ইসলামসহ ওই আমলে সমিতির নেতৃত্বে থাকা আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মানিস্যুট মামলার সিদ্ধান্ত হয়েছে সমিতির বিশেষ সাধারণ সভায়। বুধবার দুপুরে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বিশেষ সাধারণ সভায় এ অডিট রিপোর্ট উপস্থাপন করেন সমিতির সদস্যসচিব অ্যাড. নূরুল হাসান রুবা। সভায় সমিতির আহ্বায়ক অ্যাড. আব্দুল্লাহ হোসেন বাচ্চু টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, এমনটি জানতে চাইলে সাধারণ সদস্যরা সবাই মামলার ব্যাপারে সম্মতি দেন। এ সময় সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. আব্দুল মালেকের প্রস্তাবে সিনিয়র সিভিল আইনজীবীদের দিয়ে ১১ সদস্যের প্যানেল করে মামলার আরজি লেখার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। সভা চলাকালে একেকটি অর্থ আত্মসাতের ধরন দেখে অনেকেই বিস্মিত হন। সমিতির নামে ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করেও কোটি কোটি টাকার লেনদেন যেমন করা হয়, তেমনি ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে অসামঞ্জস্য লেনদেন এমনকি কারণ ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছাড়াই নামে-বেনামে টাকা আত্মসাতের চিত্র ফুটে ওঠে। আবার ব্যাংক হিসাব থেকে ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের দিন এবং পরদিনও (৬ আগস্ট) টাকা উত্তোলনের প্রমাণ মেলে। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত অডিটে এমন তথ্য ফুটে উঠে বলেও সাধারণ সভায় অডিটের বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। অডিটে ২৬ ধরনের অনিয়ম ধরা পড়ে। ৭৮ পৃষ্ঠার অডিট প্রতিবেদনে ২৬ দফা অনিয়মের বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়, গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন, ভুয়া বিল, অনুমোদনবিহীন বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিগত ঋণের নামে সমিতির তহবিল থেকে মোট ২৪ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৭২৯ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। অডিট প্রতিবেদনে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এফডিআর ও ডিপিএস বিনিয়োগে অনিয়ম। নির্বাহী পরিষদের অনুমোদন ছাড়া একাধিক এফডিআর ভেঙে নগদ উত্তোলন এবং নতুন এফডিআর খোলা হয়েছে। যার কোনোটির নথি নেই। কয়েকজন সাধারণ সদস্য ও কর্মকর্তা ব্যক্তিগত কাজে কয়েক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ফেরতের কোনো প্রমাণ নেই। অফিস রক্ষণাবেক্ষণের নামেও অর্থ আত্মসাতের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও নির্মাণকাজের জন্য ভুয়া বিল তৈরি এবং বাজার দরের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের প্রমাণ মিলেছে। গঠনতন্ত্রবিরোধী ব্যয়ও হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়াই নগদ উত্তোলন ও খরচ, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কোনো নথি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ব্যালেন্স শিটে প্রদর্শিত নগদ অর্থ ও ব্যাংক স্টেটমেন্টের হিসাব মেলেনি। আর্থিক রেজিস্টার, বিল ভাউচার ও চেক কাউন্টারফয়েল অডিট টিমকে সরবরাহ করা হয়নি। প্রাথমিক হিসাবে অনিয়মের আর্থিক পরিমাণ ২৪ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৭২৯ টাকা হলেও অডিট টিম জানিয়েছে, লুকানো বা অসম্পূর্ণ নথি পরীক্ষা করলে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আইনগত তদন্ত শুরুর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভবিষ্যতে তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত বাৎসরিক অডিট অনলাইন অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম চালু, আর্থিক লেনদেন সদস্যদের জন্য উন্মুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে অডিট প্রতিবেদনের এমন চিত্র সাধারণ সভার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলেও অভিযুক্তদের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর অ্যাড. সাইফুল ইসলামসহ তৎকালীন কেবিনেটের অনেকেই গা ঢাকা দিলেও ৬ আগস্ট ব্যাংক লেনদেন কিভাবে হয়েছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অধিকাংশ ব্যাংক হিসাবে দেখা যায়, সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী আইনজীবী সংগঠন। যেখানে সদস্য সংখ্যা এক হাজার ২০০জনেরও বেশি এবং বার্ষিক লেনদেন কয়েক কোটি টাকা ছাড়ায়। তহবিল ব্যবহৃত হয় সাংগঠনিক কার্যক্রম, সদস্য কল্যাণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও আইন সহায়তা তহবিলের জন্য। অডিট প্রতিবেদন প্রকাশের পর খুলনার আইনজীবী মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, এ ঘটনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জরুরী বিশেষ সাধারন সভায় সভাপতিত্ব করেন সমিতির আহবায়ক এ্যাড: আব্দুল্লাহ হোসেন বাচ্চু ও সভাটি পরিচালনা করেন সমিতির সদস্য সচিব এ্যাড: শেখ নূরুল হাসান রুবা। এছাড়া বক্তব্য প্রদান করেন এ্যাড: আব্দুল মালেক, এ্যাড: শেখ মাসুদ হোসেন রনি, এ্যাড: মোল্লা মোঃ মাসুম রশিদ, এ্যাড: মোল্লা মশিউর রহমান নান্নু, এ্যাড: এস এম মুজিবর রহমান, এ্যাড মো: আছাদুল আলম, এ্যাড: এ কে এম শহিদুল আলম, এ্যাড: তৌহিদুর রহমান তুষার, এ্যাড: খালিদ হাসান জনি, এ্যাড: শফিউল আলম তুতি, এ্যাড: হাবিবুর রহমান মালি, এ্যাড: মনজিলুর রহমান, এ্যাড: এহতেশামুল হক জুয়েল, এ্যাড: শরিফুল ইসলাম জোয়াদ্দার, এ্যাড: মাহাফুজুর রহমান মফিজ, এ্যাড: ফ ম মুস্তাকুজ্জামান মুক্তা, এ্যাড:মিলন মাহমুদ, এ্যাড: সাইফুল ইসলাম সুমন, এ্যাড: বজলুর রহমান রাজা, এ্যাড:তৌহিদুজ্জামান সহ আরো অনেকে। সভায় ১ জানুয়ারি ২০২০ হতে ৬ আগষ্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত অডিট রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়। উক্ত অডিটে ২৪ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৭শ’ ২৯ টাকা অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়। যা সাবেক সভাপতি এ্যাড: মো: সাইফুল ইসলাম ও সাবেক সাধারন সম্পাদক এ্যাড: কে,এম ইকবাল হোসেন এবং এ্যাড: এস এম তারিক মাহমুদ তারা আত্মসাৎ করেছেন মর্মে রিপোর্টে প্রতিয়মান হয়। উক্ত অডিট রিপোর্টে পরিলক্ষিত হয় যে, তারা নিজ ক্ষমতাবলে সমিতির বিভিন্ন ফান্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ বা অনিয়মিত খরচ করেছেন। তাই উক্ত সাধারন সভায় উপস্থিত সকলের সর্বসম্মতিতে তাদের বিরুদ্ধে সিভিল মামলা ও ফৌজদারী মামলা দায়ের করে যথাযথ শাস্তি ও আত্মসাৎকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য সকলে সম্মতি প্রদান করেন। সকলের সম্মতিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সকল ব্যবস্থা গ্রহন করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
তির সাবেক সভাপতি সাইফুল গংদের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকা আতœসাতের অভিযোগ