স্থানীয় সংবাদ

খুনের নগরী ‘খুলনা’ : চলছে ‘সিরিজ’ হত্যাকা-

এবার দৌলতপুরে মায়ের পাশে ঘুমন্ত ছেলেকে গুলি করে হত্যা
খুনিদের গ্রেপ্তারে মাঠে পুলিশের একাধিক টিম

স্টাফ রিপোর্টার : খুলনায় নিয়মিত হত্যাকা-, মরদেহ উদ্ধার, আধিপত্য বিস্তার ও মৃত্যুসহ একাধিক ঘটনা ঘটছে। এতে আতঙ্কিত নগরবাসী। একের পর এক হত্যাকা-ের ঘটনায় ‘শান্ত’ খুলনা এখন ‘অশাš’Í হয়ে উঠেছে। নগরবাসীর কাছে খুলনা এখন লাশের নগরীতে পরিণত হয়েছে। নগরীতে একের পর এক হত্যাকা-সহ অন্যান্য অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটলেও প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আগে যে নগরীর সকাল শুরু হতো কর্মমুখী মানুষের কোলাহলে, এখন সেই নগরীর সন্ধ্যা ঢেকে যায় আতঙ্কে। এমনকি নিজ ঘরেও মানুষ এই শহরে আর নিরাপদে নেই। সম্প্রতি খুলনার সর্বস্তরের আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছে খুন, ছিনতাই আর লাশ উদ্ধারের গল্পে।
এদিকে, এবার খুলনার দৌলতপুর মহেশ^রপাশা এলাকায় মা ও ছোট ভাইয়ের পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় দুর্বৃৃত্তদের ছোঁড়া গুলিতে খুন হয়েছে তানভীর হাসান শুভ (২৯) নামে এক যুবক। মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে মহানগরীর দৌলতপুরের মহেশ^রপাশা পশ্চিমপাড়া বাজার মসজিদ সংলগ্ন নিজ বাসার জানালার ফাঁক দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। বুধবার (১ অক্টোবর) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। নিহত তানভীর হাসান শুভ ওই এলাকার আবুল বাশারের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পূর্ব শক্রতার জের ধরে তাকে খুন করা হশে পারে বলে পুলিশের প্রাথমিক ধারনা। খুনের ঘটনার আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
সূত্রে জানা গেছে, নিহত তানভীর হাসান শুভ ঢাকার একটি প্রাইভেট কোম্পানীপশ চাকুরী করতো, বেশ কিছুদিন গত হলো সে বাড়ী এসেছে। (৩০ সেপ্টেম্বর) রাতে সে তার নিজ বসতবাড়ীর একটি শয়ণকক্ষে মোবাইলে ভিডিও গেম খেলা শেষ করে মা ও ছোট ভাইয়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ৩ টার দিকে তার শয়নকক্ষের পেছনের থাইগ্লাসের খোলা জানালা ফাঁক দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েন দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলি তার মাথার তালু ও বাম হাতের বাহুতে লাগে, একটি গুলি পাশের বালিশে লাগে। নিহতের মা গুলির শব্দ আচ করতে পারেননি, তিনি ভেবে ছিলেন এসি বোধহয় ব্লাস্ট হয়েছে। কিন্তু তিনি হঠাৎ তাকিয়ে দেখেন তার ছেলের মাথা দিয়ে অনাবরত রক্ত ঝরছে। তার আতœচিৎকারে ঘরে লোকজন, আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয়রা ছুটে এসে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে খুমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই খবরে তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে পুলিশ, সিআইডি, পিবিআই, ডিবির কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে ঘটনার তদন্তের কার্যক্রম শুরু করেন। ঘটনাস্থল হতে পুলিশ, একটি বুলেট ও দু’টি গুলির খোসাসহ অন্যান্য আলামত উদ্ধার করে। বুধবার (১ অক্টোবর) সকালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। প্রাথমিক সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত শেষে দুপুরে নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। বুধবার আসরের নামাযের পর পশ্চিমপাড়া শাহী জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে তার জানাযা নামাজ শেষে দাফন সম্পন্ন হয়। ওই খুনের ঘটনায় ইতোমধ্যে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।
পুলিশ বলছে, পূর্ব শক্রতার জের ধরে তাকে খুন করা হতে পারে। ঘটনাস্থল হতে একটি বুলেট ও দু’টি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। খুনের রহস্য উৎঘাটনের কাজ করা হচ্ছে, আশা করা যাচ্ছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসামীদের আইনের আওয়ায় আনা সম্ভব হবে।
এর আগে, গত ১১ জুলাই (শুক্রবার) দুপুরে দৌলতপুর থানা মহেশ^রপাশা পশ্চিমপাড়া নিজ বাড়ীর সামনে প্রাইভেটকার পরিষ্কার করার সময় দুর্বৃত্তরা গুলি ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে সাবেক যুবদল নেতা মাহবুব রহমান মোল্লাকে। পরবর্তীতে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। ওই খুনের ঘটনার পর গত ৩ আগষ্ট (রবিবার) রাতে মহেশ্বরপাশা উত্তর বনিকপাড়া খানাবাড়ী লিংক রোড এলাকায় দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন চোখঘোলা আলামিন নামের এক ব্যক্তি।
একটি সূত্র বলছে, ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে যখন শুভসহ তার ছোট ভাই ও মা একসাথে পাশাপাশি মাথা বালিশে রেখে ঘুমাচ্ছিলেন, ঠিক তখন ওই ৩ জনের মধ্যে থেকে নিশানা করে শুভকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ধারণা, এই কিলিং মিশনে কোনো প্রশিক্ষিত শুটার কাজ করেছে, যে নিখুঁত নিশানার মাধ্যেমে এই হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে। বিষয়টি গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে অনেকেই মনে করছেন। খুনের ঘটনায় মহেশ^রপাশা পশ্চিমপাড়া এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসলোও অন্যদিকে আতঙ্কিত গোটা এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে ওই এলাকার বাসিন্দা শহিদ মোল্লা জানান, সকালে এলাকায় মানুষের মুখে মুখে শুভকে গুলি করার খবর শুনে ওদের বাসায় যায়। শুভ খুব ভালো ছেলে। এ মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না, মায়ের কোলো ঘুমানো সন্তানকে গুলি করে মারলো, মানুষ কতো জঘন্য হয়ে গেছে, স্বার্থের জন্য মানুষ এখন নরপশুতে পরিনত হয়েছে। ঘরের ভেতরে থাকার পর খুন, আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?
এ বিষয়ে ওই এলাকার বাসিন্দা জানান, একটা সময় শুভ ভাইয়ের বাড়ীর পাশে থাকতাম, এখন অন্য জায়গায় থাকি। শুভ ভাইকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখে তার আম্মু আমার আম্মুকে ফোন দেয়, তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওই খবর শোনা মাত্র ছুটে আসি, অতঃপর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সকালে শুভ ভাই মারা যায়। শুভ ভাই খুব ভালো ছেলে, কারো সাথে কোনো ঝামেলা নেই। তারপরও তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো। আমার আপন ভাই না হলেও সে নিজের আপন ভাইয়ের মতো আমাকে ভালোবাসতো। তার হত্যার বিচার চাই, প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ দ্রুত সময়ের মধ্যে হত্যাকারীকে আইনের আওতায় আনুন এবং হত্যার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করুন। কেন এই হত্যা?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার বাসিন্দা জানান, জুলাই মাসে মাহবুব খুন হয়, তাকে গুলি ও পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করেন সন্ত্রাসীরা। আগস্ট মাসে মহেশ্বরপাশা উত্তর বনিকপাড়া খানাবাড়ী লিংক রোড এলাকায় দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আলামিন নামের আরেক ব্যক্তি খুন হন এবং ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে খুন হলো তানভীর হাসান শুভ। কারা এই খুনি? কি নিয়ে দ্বন্দ্ব? যে কারণে এতোগুলি খুনের ঘটনা? তিনি আরো জানান, ভাবনার বিষয় হলো, ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে যখন শুভ তার ছোট ভাই ও মা একসাথে পাশাপাশি মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন, তখন তাদের মধ্যে থেকে নিশানা করে শুভকে গুলি করে হত্যার করা হলো। এতে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, এই কিলিং মিশনে কোনো প্রশিক্ষিত শুটার কাজ করেছে, যে/যারা নিখুঁত নিশানার মাধ্যেমে এই হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে। সঠিক তদন্ত হলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে বিষয়ে নিহতের বড় মামা সিরাজুল ইসলাম জানান, আমার ভাগ্নে শুভ প্রতিদিনের ন্যায় মঙ্গলবার রাতে ঘুমাতে যায়। একই রুমে শুভ, তার মা ও ছোট ভাই ঘুমাচ্ছিল। ঘরের পেছনের জানালার ফাঁক দিয়ে শুভকে লক্ষ্য করে ৩টি গুলি ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। একটি গুলি তার মাথার তালুতে, একটি বাম হাতের বাহুতে এবং অন্যটি শুভর মায়ের বালিশে লাগে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে খুমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে সকালে সে মারা যায়।
এ বিষয়ে পাগল প্রায় নিহত শুভ’র মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমি জানালার থাইগ্লাস টানা শব্দ শুনতে পায়, ভেবে ছিলাম এসির পানি পড়ছে। শুভ গেম খেলছিল। ওকে বলি, অনেক রাত হয়েছে, এসি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ো। আমার মাথা আর শুভর মাথা এক জায়গায় ছিল। একটা শব্দ শুনি, ভেবে ছিলাম এসি কি ব্ল্যাস্ট হয়েছে। এরপর দেখি শুভর মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে। দু’জনের মাথা এক জায়গায়, আমার মাথা কেন গুলি লাগলো না। আল্লাহ তুমি আমাকে রেখে আমার বাবা কেন নিয়ে গেলে। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও, এখন আমি বাবাকে ছেড়ে কি নিয়ে বাঁচবো। আমি এ হত্যার বিচার চাই?
এ বিষয়ে দৌলতপুর থানার এসআই মো. জাকিরুল ফিরোজ জানান, মৃত্যুর খবর শুনে খুমেক হাসপাতালে যায়। প্রাথমিক সুরতহাল সম্পন্ন করি। ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুরে নিহতের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করি।
এ বিষয়ে দৌলতপুর থানা অফিসার ইনচার্জ মো. রফিকুল ইসলাম জানান, রাত সাড়ে ৩ টার দিকে বাসার জানালার ফাঁক দিয়ে দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। বুধবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে আমরা কাজ শুরু করেছি। এ ব্যাপারে আইগত পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এ বিষয়ে উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মাদ তাজুল ইসলাম জানান, আমাদের কাছে খবর আছে ভিকটিমকে মাথায় গুলি করা হয়েছে। তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে আমাদের একটি টিম যায় এবং ঘটনার সত্যতা পায়। আমরা তদন্ত শুরু করেছি। খুনের রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে আামাদের বিভিন্ন টিম কাজ করছে। আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি, ওই তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করছি, আশাবাদী দ্রুততম সময়ের মধ্যে খুনের রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে সক্ষম হবো।
উল্লেখ্য, এর আগে সর্বশেষ সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) থেকে মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সোমবার রাত ৯টার দিকে রূপসা উপজেলার জাবুসা চৌরাস্তা এলাকায় সড়কের পাশে বিল থেকে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একই দিনে রাত সাড়ে ৭ টার দিকে নগরীর লবণচরা এলাকার খুলনা-মোংলা মহাসড়কের পাশ থেকে এ অজ্ঞাতপরিচয় বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মঙ্গলবার সকাল ১০ টার দিকে খুলনা রেলস্টেশন প্লাটফর্ম থেকে প্রিন্স নামের এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। খুলনার বটিয়াঘাটায় পুকুরে পড়ে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। রোববার রাতে পুকুরে থালাবাটি পরিষ্কারের সময় তিনি পুকুরে পড়ে যান। রাতের মাঝামাঝি সময়ে তার মরদেহ ভেসে ওঠে। রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে নগরীর শিপইয়ার্ড সড়কের হাজি মালেক কলেজ এলাকায় এক ছিনতাইকারী আরেক ছিনতাইকারী গুলি করে।
সূত্রে আরো জানা গেছে, সম্প্রতি খুলনায় উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে নদ-নদীতে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা। গত এক বছরে খুলনায় নদী থেকে অন্তত ৫০টি মরদেহ উদ্ধার করেছে নৌ-পুলিশ। এছাড়া খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অষ্টম মাসে খুলনা মহানগরে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৮টি। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ৩১টি হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। এই ৩১টি হত্যা মামলায় পুলিশ ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর চলতি বছরে ১৮টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৬৯ জন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত একই সময়ে হত্যা মামলার সংখ্যা ছিল ১৯।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button