৪ শিবির নেতাকে হাত-চোখ বেঁধে পঙ্গু করার অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে
প্রবাহ রিপোর্ট : বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের আরও চার নেতাকে গুম করার পর গভীর রাতে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় পায়ে গুলি করে পঙ্গু করার অভিযোগে র্যাব-ডিবি ও পুলিশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এসে ভিক্টিম ছাত্রশিবির নেতারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে এ অভিযোগ দায়ের করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন ইসলামি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও সহকারী আইন সম্পাদক আমানুল্লাহ আদিব। গুম হওয়া ইসলামি ছাত্রশিবিরের চার নেতা হলেন- মো. আবুজর গিফারী, ওমর আলী, মো. রুহুল আমিন ও ই¯্রাফিল হোসেন। মো. আবুজর গিফারী ২০১৫ সালে গুম হওয়ার সময় জয়পুরহাট জেলার ছাত্রশিবিরের সভাপতি এবং ওমর আলী একই জেলার ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ছিলেন। অপরদিকে মো. রুহুল আমিন ছাত্রশিবিরের যশোর জেলা পশ্চিম চৌগাছা উপজেলা সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন এবং ই¯্রাফিল হোসেন একই থানার সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। অভিযোগ দায়ের করার বিষয়ে ছাত্রশিবিরের আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসন আমলে ছাত্রশিবিরের ওপর সর্বোচ্চ বর্বরতা চালানো হয়। অভিযোগ দায়েরকারী চার শিবির নেতা এই বর্বরতার শিকার। পুলিশের বর্বর নির্যাতনের কারণে তাদের পা কেটে ফেলা হয়েছে এবং কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে। রাত ৩টার দিকে আবুজর গিফারী ও ওমর আলীর পায়ে গুলি করে তাদের পা ঝাজরা করে দেওয়া হয়। একইভাবে রুহুল আমিন ও ই¯্রাফিল হোসেনকে গভীর রাতে নির্জন স্থানে নিয়ে হাতে হ্যান্ডকাপ পড়ানো হয় এবং চোখবাঁধা অবস্থায় তাদের দুজনের দুপায়ে গুলি করে ঝাঝরা করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ছাত্রশিবিরের দায়িত্ব পালন করার কারণে এই সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে। এইরকম অসংখ্য নজির ছাত্রশিবিরের জনশক্তিতে রয়েছে। আমরা সেগুলো ক্রমন্বয়ে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করবো। তাদেরকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসবো। তিনি বলেন, জয়পুরহাটের ১২ জন এবং চৌগাছা থানার ৯ জন র্যাব ও পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। ভিক্টিম ছাত্রশিবির নেতা আবুজর গিফারী বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনকালে ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীর ওপর জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে। এই জুলুম নির্যাতনের বিচারের প্রক্রিয়া স্বরূপ আজ আমরা এখানে এসেছি। আমাদের ওপর যে অন্যায় হয়েছে, যে জুলুম নির্যাতন হয়েছে, সেগুলোর বিচার নিশ্চিত করার জন্য এখানে এসছি। তিনি বলেন, পায়ে গুলি করার পর শুধু ড্রেসিং ও রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের ভাইয়েরা অনেক চেষ্টা করেছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। বার বার আবেদন করার পরও আমাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। অবশেষে আমাদের পাগুলো বিনা চিকিৎসায় পচে যায়। পরে ঢাকায় এসে ডাক্তার সিদ্ধান্ত দেন পা পচে গেছে। কেটে ঠেলতে হবে।
ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগে যা বলা হয়েছে: ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে, আবুজর গিফারী জয়পুরহাট জেলার তৎকালীন জেলা সভাপতি এবং ওমর আলী ছিলেন তৎকালীন জেলা সেক্রেটারি। ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর জেলা শাখার বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য জয়পুরহাট থেকে হানিফ বাসে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। আব্দুল্লাহপুর আসলে ৯ ডিসেম্বর সকাল ৬টার দিকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে দুজনকেই মাইক্রোবাসে উঠিয়ে উত্তরা র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৫ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে তাদেরকে মাইক্রোবাসে করে হাত এবং চোখ বেধে রাজশাহী র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৫ ডিসেম্বর রাত এবং ১৬ ডিসেম্বর সারাদিন আবারও চালানো হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন। ১৬ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে রাজশাহী থেকে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচবিবি থানায় শিমলতলী এলাকায়। অতঃপর সেখান থেকে তাদের সঙ্গে বোমা ও অস্ত্র দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তাদেরকে রাত ৪টার দিকে জয়পুরহাট র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় আবারো শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন। এরপর সকাল ১০টার দিকে অস্ত্র এবং বোমাসহ সংবাদ সম্মেলন করেন জয়পুরহাট র্যাবের তৎকালীন মিডিয়া উয়িং। দুপুরে পাঁচবিবি থানার কাছে তাদেরকে অস্ত্র মামলা দিয়ে হস্তান্তর করা হয়। অতঃপর সেখানে রাত ২টা পর্যন্ত দফায় দফায় পুলিশ নির্যাতন চালায়। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে তাদেরকে হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় আওলায় ইউনিয়নের একটি পরিত্যক্ত জায়গায়। পুলিশ দুজনের হাটুতে গুলি করে পা ঝাঝরা করে দেয়। তাদেরকে স্থানীয় হসপিটালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে রেফার করে দেন। সেখানেও তাদের চিকিৎসা না দিয়ে ঢাকার পঙ্গু হসপিটালে রেফার করে দেয়। সেখানে অপারেশন করে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়। ২ জনেরই প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় মাংস ৭৫ শতাংশ পঁচে যাওয়ায় ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে দুজনের অনুমতি সাপেক্ষে ২টি পা কেটে ফেলা হয়। হসপিটাল থেকে রিলিজ হলে ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে চিকিসসাধীন অবস্থায় জয়পুরহাট কারাগারে পাঠানো হয়।
রুহুল আমিন ও ই¯্রাফিল হোসেনের গুমের ঘটনা: মো. রুহুল আমিন ইসলামি ছাত্রশিবিরের যশোর জেলা পশ্চিম চৌগাছা উপজেলা সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ই¯্রাফিল হোসেন একই থানা সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট সাংগঠনিক কাজ শেষ করে রুহুল আমিন বাড়ি যাওয়ার পথে বন্দুলীতলা শফি মল্লিকের ইটভাটার মোড় থেকে চৌগাছা থানার একজন এস আই এবং দুজন এ এস আই তাদেরকে গ্রেপ্তার করে চৌগাছা থানায় নিয়ে যায়। ৪ আগস্ট তাদেরকে ডিবি কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদেরকে আবার চৌগাছা থানায় নিয়ে আসার পথে কয়ারপাড়া এলাকায় আসলে দুজনেরই দুই হাত পেছন মুড়ো করে হ্যান্ডকাপ পড়ানো হয় এবং চোখ বেঁধে ফেলা হয়। গভীর রাতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বন্দুলিতলার নির্জন মাঠে। সেখানে নিয়ে দুজনের হাটুতে পুলিশ গুলি করে পা ঝাঝরা করে দেয়। সেখান থেকে তাদেরকে উপজেলা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই তাদের রেফার করা হয় যশোর সদর হসপিটালে। সেখানে ২দিন চিকিৎসার পর কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাদেরকে ঢাকার পঙ্গু হসপিটালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভর্তি হওয়ার ৭দিন পর পায়ে পচন ধরলে ডাক্তার পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত দেয় এবং পা কেটে ফেলা হয়। ইত্যেমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করে যে বন্ধুক যুদ্ধে ২ শিবির নেতা আহত। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা রুজু করে ২ মাস চিকিৎসার পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে।