জাতীয় সংবাদ

শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনাসহ নানা ইস্যু নিয়ে দ্য হিন্দুর সঙ্গে আলাপ ড. ইউনূসের

প্রবাহ রিপোর্ট : বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন পূরণ হয়েছে। এ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দু। ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় দেওয়া সাক্ষাৎকারটি গত সোমবার হিন্দুর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ, নির্বাচন, সংস্কার, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনাসহ নানা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন ড. ইউনূস। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হবে কি না? হিন্দুর সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দারের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এটা এরইমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। বিএনপি এটা করেছে। বলেছে, সব রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। সুতরাং তারা এরইমধ্যে রায় দিয়ে দিয়েছে। আমরা দেশের একটি প্রধান দলের মতামতকে উপেক্ষা করতে পারি না। তাহলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আপনার কোনও আপত্তি নেই- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি কোনও রাজনৈতিক নেতা নই যে কোনও একটি দল বা আরেকটি দলকে বেছে নেব। আমি শুধু রাজনীতিবিদদের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করার চেষ্টা করছি। সাক্ষাৎকারে নিজের দল ও তা বন্ধ করে দেওয়া প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন ড. ইউনূস। সেই সঙ্গে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, নিজেকে তিনি কখনোই রাজনীতিবিদ মনে করেন না। তাহলে নির্বাচন কবে হচ্ছে? এই সরকার কতটা ‘স্বল্পস্থায়ী’? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেছেন, আমরা যখন দায়িত্ব নেই, তখন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেই যে, আমরা শুধু একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হব না, যারা এসে নির্বাচন করবে এবং দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো বাংলাদেশের জন্য সংস্কার আনা। তবে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে চাইনি। তিনি বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে। এটি একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া। অন্যদিকে সংস্কারের প্রক্রিয়াও সমান্তরালভাবে চলছে। আমরা নির্বাচন কমিশন তৈরি করেছি। আমরা আশা করি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের নাম ঘোষণা করা হবে। তারা একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করবে যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালিত হয়। কিন্তু তারা কোনও নির্বাচন করতে পারবে না যতক্ষণ না অন্যান্য সংস্কারগুলো কার্যকর হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমাদের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হবে কি না। বাংলাদেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে কি না। মেয়াদ এবং মেয়াদের সীমা কেমন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে দেওয়া বিবৃতির কথা তুলে ধরে হিন্দুর সাংবাদিক জানতে চান, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সময়ও বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত থাকার বিষয়ে তিনি কতটা আত্মবিশ্বাসী? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংলাদেশ নিয়ে কোনও বিবৃতি দেননি। হিন্দুর সাংবাদিক বলেন, তিনি দিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে…। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, সম্ভবত ট্রাম্প সঠিকভাবে অবগত নন। এটা অপপ্রচার, যা বিশ্বজুড়ে চলছে। কিন্তু যখন তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বাস্তবতা সম্পর্কে জানবেন, তখন ট্রাম্প অবাক হবেন যে তাকে কতটা ভিন্নভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি না, শুধু যুক্তরাষ্ট্রে একজন নতুন প্রেসিডেন্টের কারণে সবকিছু বদলে যাবে। পররাষ্ট্রনীতি ও দেশের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক প্রেসিডেন্ট পদে পরিবর্তনের কারণে সাধারণত পরিবর্তিত হয় না। তাছাড়া ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যদি পরিবর্তন হয়ও তাহলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এটাও বাংলাদেশ ২; যেটাকে আমরা বলছি নতুন বাংলাদেশ। সুতরাং আমরা অপেক্ষা করব। যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আসেন ও দেখেন এবং যদি আমাদের অর্থনীতি ভালো করতে থাকে তাহলে তারা আগ্রহী হবে। তারা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সরকারি ক্রেতা, আমরাও তাই। বছরের পর বছর ধরে দুদেশের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমাদের আশা, এটা আরও জোরদার হবে। হিন্দুর সাংবাদিক বলেন, ট্রাম্পের কথাকে আপনি অপপ্রচারের ফল বলছেন। কিন্তু শুধু তিনি নন, ভারত সরকারও বাংলাদেশে হিন্দুদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে হত্যা করা হয়েছে, এমনকি ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, এসব ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটি বিবৃতি দিয়েছেন। আপনি এটার ক্ষেত্রে কী বলবেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে প্রথম ফোনালাপেই (১৬ আগস্ট) সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে খারাপ আচরণের প্রসঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু আমি তাকে স্পষ্টভাবে বলেছিলাম, এগুলো অপপ্রচার। সংবাদমাধ্যমে খবরগুলো যেভাবে এসেছে, সেভাবে হয়নি। হিন্দুর সাংবাদিকের প্রশ্ন, তাহলে এর পেছনে কে আছে বলে আপনি মনে করেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি জানি না। কিন্তু এসব প্রচারণা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। সব ঘটনার পেছনে একদল ব্যক্তি রয়েছেন। ভারতে নির্বাসিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশ ব্যবস্থা নেবে বলেও জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। গত ৫ আগস্ট থেকে ভারতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। তার উপস্থিতি (ভারত-বাংলাদেশ) সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে…দ্য হিন্দু সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দারের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এ সময় ভারতে অবস্থান কোনও সমস্যা নয়। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে তার কথা বলাটা সমস্যা। তিনি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। আর সেগুলো রাজনীতি নিয়ে। তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন, এটাই সমস্যা। হিন্দু সাংবাদিকের প্রশ্ন, সেটা কীভাবে? উত্তরে ড. ইউনূস বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) মানুষকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বলছেন। ঢাকা ও অন্যান্য শহরের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে বলছেন। তার অডিও ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে তিনি মানুষজনকে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি (ঢাল হিসেবে) সঙ্গে রাখতে বলছেন। যেন পুলিশ বাধা দিলে তারা বলতে পারেন, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এটি অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আপনার সরকার ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে… ভারতের কাছে সরাসরি এ অনুরোধ করা হলো না কেন? এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থা রয়েছে। সুহাসিনীর এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, তাকে ফিরিয়ে আনতে আমরা সব আইনি পথ অবলম্বন করব। হিন্দু সাংবাদিকের প্রশ্ন, প্রকৃতপক্ষে এখনও আপনার সরকার তার প্রত্যার্পণের অনুরোধ জানায়নি। দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি মনে করি আমরা সেই পথে আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি, তবে আমরা এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছাইনি। প্রশ্ন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিচার করা হচ্ছে-এমন যুক্তি দেখিয়ে ভারত যদি অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে কী হবে? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আপনি কি বলছেন, ভারত চুক্তি লঙ্ঘন করবে? হ্যাঁ, চুক্তিতে এমন কিছু ধারা রয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার যদি তাকে (শেখ হাসিনা) সেখানে রাখতে এগুলো প্রয়োগ করে, তাহলে সেটা আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলবে না। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ খুবই স্বল্পস্থায়ী। তাই এই সময়ে হয়তো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সবকিছু মীমাংসা করা যাবে না। তবে আমাদের পরে যে সরকারই আসুক না কেন, তারা এটা ক্ষমা করবে না। সাংবাদিকের প্রশ্ন, আপনি কি মনে করেন, অন্য বিষয়গুলোতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক মসৃণভাবে এগোবে? সম্প্রতি আমরা জ্বালানি ও বাণিজ্য সংযোগে কিছু উদ্যোগ দেখেছি।’ জবাবে, ড ইউনূস বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন হলো এমন একটি সম্পর্ক তৈরি করা, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো। (ইইউভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ ও বাণিজ্যের অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে)। আপনি যা উল্লেখ করেছেন, তা ভালো ইঙ্গিত এবং আমরা সেই দিকেই এগোতে চাই। তবে এটি এখনও আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে বহু দূরে। আমরা খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একটি ঐক্য চাই। যমজের মতো একসঙ্গে থাকার জন্যই আমরা জন্মেছি।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button