জাতীয় সংবাদ

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। চারদিকে বাঙালির বিজয় নিশান উড়ছে। পাকিস্তানকে রক্ষায় মরিয়া মার্কিন-চীনের কূটনৈতিক চেষ্টাও ব্যর্থ করে দিয়েছে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। একাত্তরের রক্তঝরা এদিনে পাকিস্তানের চলমান যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রাশিয়া তৃতীয়বারের মতো ভেটো দেয়। রাশিয়ার ভেটোতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ হয়ে না গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন আরও দেরি হতো। এদিকে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল বুদ্ধিজীবী অপহরণের পরিমাণ ততই বাড়তে লাগল। একাত্তরের এই দিনে বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন আহমদ, দৈনিক পূর্বদেশের শিফট ইনচার্জ এ এন গোলাম মোস্তফাকে তাঁদের বাসভবন থেকে আলশামস-আলবদর বাহিনী অপহরণ করে। তাঁরা আর ফিরে আসেননি। ১৯৭১ সালের এই দিন দেশের বেশিরভাগ এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে ঢাকা দখলের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে এগোতে থাকে শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায় বীর বাঙালি। বাংলাদেশ নামের দেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে না পেরে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব ও মেধাশূন্য করতে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের নিয়ে ঘৃণ্য ও বর্বর ষড়যন্ত্র চালানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকে। চালাতে থেকে শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে নিষ্ঠুর ও নির্মম কায়দায় হত্যাযজ্ঞ। যুদ্ধজয়ের নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখে মিত্রবাহিনী যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে। কারণ তারা জানমালের ক্ষতি কম করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের দিকে নিয়ে যায়। ঢাকা দখল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। বালীগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে বসে বার্তা বিভাগীয় প্রধান কামাল লোহানী, আলী যাকের, আলমগীর কবির ঘন ঘন সংবাদ বুলেটিন পরিবেশন করে চলেছেন। আজ থেকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ দখলদারমুক্ত হতে চলেছে এই সংবাদে প্রতিটি বাঙালি উদ্বেলিত। শরণার্থী শিবিরগুলোতে স্বাধীন দেশে ফেরার প্রস্তুতি চলছে। স্বাধীন মানুষের মনে ঘরে ফেরার আনন্দ আর নতুন জীবনের প্রত্যাশা। আজকের এ দিনে চতুর্থ বেঙ্গল চট্টগ্রামের দিকে এগোনের পথে নাজিরহাটে হানাদাররা বাধা দেয়। এখানে ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তাদের তিন কোম্পানি এবং বেশকিছু ইপিসিএএফসহ অবস্থান নিয়েছিল। এখানে ব্যাপক যুদ্ধের পর পালিয়ে যায় হানাদাররা। এদিকে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে যতই অগ্রসর হচ্ছিল, ততই কমছিল কথিত দুর্র্ধষ পাকিস্তানি জেনারেলদের মনোবল। উত্তর দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী ও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হালকা প্রতিরোধ ব্যর্থ করে কালিয়াকৈর পর্যন্ত এসে পৌঁছান। একই দিনে বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসেবে ২০-ইবি ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে মুরাপাড়ায় পৌঁছায়। পূর্ব দিকে ডেমরা ফেরির দিকে অগ্রসরমাণ ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সমুদ্রপথে শত্রুদের পালানোর সুযোগ কমে যাওয়ায় ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদারদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ঢাকা চূড়ান্ত লড়াইয়ের স্থল বলে চিহ্নিত হতে থাকায় সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও দ্রুত বাড়তে থাকে। ঢাকার আকাশ ভারতীয় বিমানবাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকায় তারা পাকিস্তানি সামরিক অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালাতে থাকে। ঢাকার সর্বত্র অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। পাকিস্তানি সেনানায়কদের মনোবল উঁচু রাখার সামান্যতম অবলম্বন কোথাও ছিল না। তাদের একমাত্র ভরসা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। কিন্তু একাজেও ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক বৃহৎ নৌযান ২৪ ঘণ্টা নিশ্চল রাখার পর এদিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোতে শুরু করে। ইসলামাবাদে বারবার সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছিল পাক হানাদাররা। ইসলামাবাদ থেকে সামরিক কর্তারা ঢাকায় অবস্থানরত ঘাতকদের এই বলে আশ্বস্ত করে, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে, আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। পশ্চিম খ-ে ভারতীয় বাহিনীকে এমন মার দেওয়া হবে যে, তারা নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইবে ও যুদ্ধ থেমে যাবে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সেদিন আর আসেনি। যুদ্ধজয়ের নিশ্চয়তা জেনেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মী, কূটনৈতিক, প্রতিনিধি ও বিদেশী নাগরিক নিরাপদে সরে আসতে চান বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্ভাব্য সব রকমের সুযোগ-সুবিধা দেবে। প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করে। আজ সাতক্ষীরার বেসামরিক প্রশাসন কাজ শুরু করে। এদিকে শান্তি কমিটি, ডা. মালিক মন্ত্রিসভা ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের বেশিরভাগই অবস্থা বেগতিক দেখে গা-ঢাকা দেয়। কিন্তু এর মধ্যেও ঘাতক আলবদর চক্র সক্রিয় ছিল। যার নির্লজ্জ বহির্প্রকাশ ঘটেছে দেশের সবচেয়ে কৃতী সন্তানদের পরিকল্পিত হত্যাকা-ে। এবার মহান বিজয়ের ৫২ বছরপূর্তি। অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী। উৎসাহ-উদ্দীপনায় নানা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ পালন করছে বিজয়ের মাসব্যাপী কর্মসূচি। একমাত্র স্বাধীনতার শত্রুরা ছাড়া প্রতিদিনই নানা কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে স্মরণ করছে প্রিয় মাতৃভূমির জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, ঘৃণা-ধিক্কার জানাচ্ছে স্বাধীনতার শত্রু এদেশীয় রাজাকার, আলবদর ও মানবতার শত্রু যুদ্ধাপরাধীদের।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button