জাতীয় সংবাদ

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

এফএনএস: কবি জসীম উদ্দীনের ‘একুশের গান’ কবিতায় লিখেছেন-আমার এমন মধুর বাঙলা ভাষা/ভায়ের বোনের আদর মাখা/ মায়ের বুকের ভালবাসা।’ আবার কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতায় লিখেছেন-এখানে যাঁরা প্রাণ দিয়েছে/ রমনার উর্ধমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়। মাতৃভাষা আন্দোলনের ওপর দেশ বিদেশের বহু কবি সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলনের জানা অজানা অনেক বিষয় নিয়ে লিখেছেন। বিশ্বের ইতিহাসে ভাষার আন্দোলন শুধু এদেশেই হয়েছে। আর কোন দেশে মায়ের মুখের ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়নি। পাশের দেশ ভারতে সাংবিধানিকভাবে ২২ ভাষা স্বীকৃত। এর বাইরে আরও কয়েক শ’ ভাষায় দেশটির জাতি গোষ্ঠী কথা বলেন।

মাতৃভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক স্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র তা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান জন্মের আগেই। তদানীন্তন পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল এটা ঐতিহাসিক সত্য। এ সময় পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে যাদের আধিপত্য ছিল তার বেশিরভাগই ছিল হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী শ্রেণীর। এ কারণে মুসলমানরা এ সময় মুসলিম জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। এটা ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। পাকিস্তান জন্মের পর এদের আশা হতাশায় পরিণত হলো। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিম-লে বাঙালীদের তেমন আধিপত্য রইল না। তারা ক্রমেই শোষণ বঞ্চনার শিকার হতে লাগল। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যেই অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে লাগল। নানা শোষণ বঞ্চনার শিকার হয়ে তারাই আবার পাকিস্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিযে নিল। তখন বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনায় সঞ্চারিত হতে লাগল। এর পর এল মাতৃভাষা বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ। গর্জে উঠল সমগ্র বাঙালী সমাজ। ’৫২ ভাষা আন্দোলন বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রথম স্ফূরণ। ১৯৪৭ সালের শেষেরদিকে করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ওই সময় পাকিস্তানের ডাক টিকিট, মানি অর্ডার ফর্ম ইত্যাদি উর্দু ও ইংরেজীতে লেখা থাকত। তখন থেকেই বাংলাকে উপেক্ষা করা শুরু হলো। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র বিক্ষোভ হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। তখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ফজলুর রহমান এবং পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন। যদিও এরা দু’জনেই ছিলেন বাঙালী অথচ তারা উর্দুকে সমর্থন দিলেন। ওই সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে গণপরিষদের সভা বসল। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বিল আনা হলো। পূর্বপাকিস্তানের একজন সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৬ কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই বাঙালী। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে কেন রাষ্ট্রভাষা করা হবে না? সেদিন তাকে তিন গণপরিষদ সদস্য ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও প্রেমহরি বর্মণ সমর্থন জানান। ভাষা সৈনিক ডাক্তার ননীগোপাল সাহা রচিত ‘আমার দেখা ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি’ গ্রন্থে এভাবেই মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে বলা হয়েছে।

এমআর মাহবুবের লেখা ‘রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে প্রথম’ গ্রন্থে প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৯৪৮ সালে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে কামরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সম্প্রসারণ করে প্রথম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এটি তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যুক্ত রাষ্ট্রভাষা সাব কমিটি বা সম্প্রসারিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে পরিচিত। প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন শামসুল আলম।

প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিল ২৮ জন। তালিকাটি নিম্নে প্রদান করা হলো-
শামসুল আলম (আহ্বায়ক), আব্দুল মান্নান (যুগ্ম আহ্বায়ক), অধ্যাপক আবুল কাসেম (পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ আহ্বায়ক), কামরুদ্দীন আহমদ (গণআজাদী ছাত্রলীগ আহ্বায়ক), সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভিপি, এসএম হল), মোহাম্মদ তোয়াহা (ভিপি, ফজলুল হক হল), অলি আহাদ (ঢাকা সিটি মুসলিম ছাত্রলীগ আহ্বায়ক), আব্দুর রহমান চৌধুরী (পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ), শামসুল হক (গণতান্ত্রিক যুবলীগ), লিলি খান (মুসলিম ছাত্রলীগ), আনোয়ারা খাতুন (এমএলএ/পূর্ব-পাকিস্তান মহিলা সংহতি সম্পাদিকা), তোফাজ্জল আলী (এমএলএ, পরে রাষ্ট্রদূত) আলী আহমদ খান (এমএলএ) কাজী নজমুন হক (জিন্দেগী সম্পাদক), আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী (পরে ইনসাফ সম্পাদক), কাজী জহুরুল হক (পূর্ব-পাকিস্তান পিপলস লীগের সেক্রেটারি জেনারেল), নুরুল হুদা (ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ভিপি), মির্জা মাজহারুল ইসলাম (ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রতিনিধি), তসাদ্দক আহমদ চৌধুরী (গণতান্ত্রিক যুবলীগের সভাপতি), শাহেদ আলী (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব-পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগ), শওকত আলী আবদুস সালাম (সম্পাদক, দৈনিক পূর্ব-পাকিস্তান), অধ্যাপক রেয়াত খান (একমাত্র উর্দুভাষী সদস্য), খালেক নওয়াজ খান (ছাত্রলীগ), আজিজ আহমদ।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম হরতাল সম্পর্কে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেক্রেটারিয়েট ও বিভিন্ন সরকারী অফিসের সম্মুখে পুলিশের ব্যাটন চার্জের ফলে বাংলার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মি. মোহাম্মদ তোয়াহা ও তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক অধ্যাপক এ কাসেমসহ প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছেন। অদ্য সকাল হতেই মুসলমান ছাত্ররা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে, সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট, জেনারেল পোস্ট অফিসে, টেলিগ্রাফ অফিস, ইনকাম ট্যাক্স অফিস প্রভৃতি সরকারী অফিসগুলোর সম্মুখে পিকেটিং করতে আরম্ভ করে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button