জাতীয় সংবাদ

অবশেষে পাওয়া গেল ‘আয়নাঘর’এর ভয়াবহ চিত্র!

# জানালাহীন এগজস্ট ফ্যান-‘শক’চেয়ার বহন করছে নির্যাতনের চিত্র #
# সারাক্ষণ এগজস্ট ফ্যান চলত খুপড়ি ঘরগুলিতে, ফ্যান বন্ধ হলেই কান্না আর গোঙানির শব্দ শুনতে পাওয়া যেত #

প্রবাহ রিপোর্ট ঃ আগারগাঁও অঞ্চলের আয়নাঘরের দায়িত্বে ছিল ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি)। সেখানে একটি চেয়ার দেখে যেন থমকে যান সবাই। সেই চেয়ারে বসিয়ে ‘হাই ভ্যালু’ বন্দিদের ইলেকট্রিক শক দেওয়ার বর্ণনা শোনেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্যান্য উপদেষ্টা, ভুক্তভোগী ও দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা। এ চেয়ারটাই বলে দিচ্ছে ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনার আয়নাঘরে কি ঘটতো একজন বন্দির সঙ্গে। ধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) আয়নাঘর নামে খ্যাত ঢাকার তিনটি স্থান পরিদর্শন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। যেগুলো পূর্বে নির্যাতন কক্ষ এবং গোপন কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গোপন কারাগারগুলো পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়াত প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা (গোপন কারাগার) তার একটি নমুনা।’ প্রধান উপদেষ্টার এ কথার চেয়েও যেন ভয়াবহ চিত্র গোপন কারাগারগুলোতে, যা অধিক পরিচিতি পেয়েছে আয়নাঘর নামেই। দিনের পর দিন একেকজন বন্দি মানুষ গুম থাকা অবস্থায় কীভাবে রোজনামচা লেখে বা তার সংকেত লিখে যায়, কীভাবে দিন গণনা করে, তার ধারণা মেলে গোপন কারাগারগুলোতে। রাজধানীর আগারগাঁও অঞ্চলের আয়নাঘর পরিদর্শনে দেখা যায়, একটি স্টিলের চেয়ার। যেখানে ইলেক্ট্রিক শকের সব ধরনের ব্যবস্থা। ভুক্তভোগীদের বর্ণনা মতে, নির্যাতনের জন্যেই এই চেয়ার ব্যবহার করা হতো। বেশির ভাগ সময়েই ‘হাই ভ্যালু’ বন্দিদের ইলেক্ট্রিক শক দিতে ব্যবহার হতো এই চেয়ার। ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) ছিল এই আয়নাঘরের দায়িত্বে। সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গোপন বন্দিশালাগুলো দেখতে খুবই ছোট। অধিকাংশই তিন ফুট বাই চার ফুটের মধ্যে। যেখানে একজন বন্দির নিজের মতো করে করার কিছুই নেই। ওপরে এগজস্ট ফ্যান বা ভেন্টিলেটর জাতীয় ফ্যান লাগনো। কোনো কোনো কক্ষে দুটি। যেখান থেকে শ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস, কিছুটা আলোও আসতো। কিন্তু এমন কক্ষের মধ্যেই বন্দির প্রসাব-পায়খানার জায়গা। এরমধ্যেই দিনের পর দিন আটক রাখা হতো।
কোনো কোনো কক্ষে শুধু ছোট একটা হোলের (ছিদ্র) মতো। যেটা আবার বেশিরভাগ সময়েই লাগিয়ে রাখা হয়। দেখা গেছে, ড্রেনেজ সিস্টেম। বন্দী ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী, ওখানেই বন্দিকে প্রস্রাব-পায়খানা, গোসল করতে হতো। জায়গাটা সর্বোচ্চ সাড়ে তিন ফুট বাই চার ফুট। বছরের পর বছর, মাসের পর মাস এভাবে রাখা হতো তাদের। সারাক্ষণ এগজস্ট ফ্যান চলত খুপড়ি ঘরগুলিতে, ফ্যান বন্ধ হলেই কান্না আর গোঙানির শব্দ শুনতে পাওয়া যেত। পরিদর্শনে গিয়ে নিজেদের বন্দী জীবনের বিভৎসতার কথাও মনে পড়েছে দুই উপদেষ্টা নাহিদ ও আসিফের। তাদেরকেও ৫ আগস্টের আগে ওই গোপন বন্দিশালায় বন্দি রাখা হয়েছিল। তারা গোপন বন্দীশালার কোনো কক্ষে ছিলেন, নিজেরাই শনাক্ত করেছেন। গত জুলাই মাসে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়েছিল তাদের। এরপর টর্চার সেলে (নির্যাতন কেন্দ্র) রাখা হয়। প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি গতকাল তার ফেসবুকে দেওয়া পৃথক পোস্টে এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর তিনটি এলাকায় গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছেন, যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত। সুচিস্মিতা তিথি ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে একটি কক্ষের কয়েকটি ছবি দিয়েছেন। একটি ছবিতে নাহিদ ইসলাম রয়েছেন। সুচিস্মিতা তিথি লিখেছেন, গত জুলাইয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পর ডিজিএফআইয়ের এই টর্চার সেলে (নির্যাতন কেন্দ্র) রাখা হয়েছিল নাহিদ ইসলামকে। আজ সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে কক্ষটি শনাক্ত করেন নাহিদ। এই কক্ষের একপাশে টয়লেট (শৌচাগার) হিসেবে একটি বেসিনের মতো ছিল বলে জানান তিনি। ৫ আগস্টের পর এই সেলগুলোর মাঝের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়, দেয়াল রং করা হয়। সুচিস্মিতা তিথি ফেসবুকে আরেকটি পোস্টে অপর একটি কক্ষের কয়েকটি ছবি দিয়েছেন। একটি ছবিতে আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া রয়েছেন। সুচিস্মিতা তিথি লিখেছেন, গত জুলাইয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পর ডিজিএফআইয়ের এই টর্চারসেলে রাখা হয়েছিল আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াকে। আজ সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে কক্ষটি চিনতে পেরেছেন তিনি। দেয়ালের ওপরের অংশের খোপগুলোতে এগজস্ট ফ্যান ছিল বলে জানান তিনি। প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও আয়নাঘর পরিদর্শনে ছিলেন বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ ভুক্তভোগী ও সাংবাদিকরা।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button