আগ্নিঝরা মার্চ’ ৭১

স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের পথে আরও এক ধাপ
এফএনএস: ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চÑস্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত বাঙালির জন্য ছিল এক উত্তাল দিন। চারদিকে ফুঁসে উঠছিল মুক্তিকামী জনতা, অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চূড়ান্ত ডাকের। ঢাকার রাজপথে তখন প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উড়ছিল কালো পতাকা। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত গাড়ির ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডেও শোভা পাচ্ছিল কালো পতাকা, আর উইন্ডস্ক্রিনে উড়ছিল বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকাÑসবুজ জমিনে লাল সূর্যের মাঝে অঙ্কিত স্বাধীনতার মানচিত্র।
সকাল পৌনে ১১টায় ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু গাড়ি নিয়ে বের হন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য। কিন্তু এই আলোচনা ছিল নিছক সময়ক্ষেপণ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আরেকটি চক্রান্ত। গত কয়েক দিনে যেভাবে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর এ ছিল এক প্রতীকী প্রতিবাদ।
সকাল ১০টায় শুরু হওয়া বৈঠক চলে দুপুর ১২টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এটি অব্যাহত থাকবে। তবে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যই ইঙ্গিত দিচ্ছিল, আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু সমাধান আসছে না।
ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের পর সংবাদপত্রগুলোর শিরোনাম উঠে আসেÑ“সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রাষ্ট্রীয় নীতি ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন।”
কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। একদিকে বঙ্গবন্ধু আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজতে চাইছিলেন, অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান গোপনে রক্তের হোলিখেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। একদিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন, অন্যদিকে গণহত্যার পরিকল্পনাÑএই বিপরীত অবস্থানেই বোঝা যাচ্ছিল, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কোনো সমঝোতার পথে নেই।
এই দিনেও অসহযোগ আন্দোলন ছিল টানা ১৬ দিন ধরে চলমান। বঙ্গবন্ধুর নতুন নির্দেশ অনুযায়ী ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক শুল্ক, কর, আবগারি কর ও বিক্রয় কর গ্রহণ করবে, কিন্তু তা স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে জমা দেবে না। এটি ছিল অর্থনৈতিক প্রতিরোধের এক বড় পদক্ষেপ।
একই দিনে ময়মনসিংহে এক বিশাল জনসভায় মওলানা ভাসানী দাবি তোলেনÑ“বাংলাদেশের পাওনা বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিন।” চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বুদ্ধিজীবী সমাবেশে অধ্যাপক আবুল ফজল, সৈয়দ আলী আহসান, ড. আনিসুজ্জামানসহ অনেকে অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান।
স্বাধীনতার অগ্নিমশাল জ্বলতে দেখে পাকিস্তানি সেনারা দমন-পীড়ন আরও বাড়িয়ে তোলে। সাতক্ষীরায় মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় নিরীহ মানুষকে। দেশের মানুষকে অনাহারে মারার ষড়যন্ত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা চার জাহাজ বোঝাই গম চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস না করে করাচিতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যদিও এটি ছিল ত্রাণ সহায়তা।
দেশের সর্বত্র কালো পতাকা উড়ছিল। মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। পেশাজীবী, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রÑসবাই স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছিল। রাজপথে, মাঠে-ময়দানে গানে, নাটকে, পথনাটকে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছিল উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সংসদ ও মহিলা পরিষদসহ নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন। হাইকোর্টের আইনজীবী, বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করে।
১৬ মার্চের দিনটি ইতিহাসে প্রমাণ করে, বাঙালি আর পিছু হটার জন্য আন্দোলন করেনি। তারা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত ছিল, জীবন বাজি রাখার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। আলোচনার নামে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে চক্রান্ত করছিল, তা বাঙালির চোখে ধুলো দিতে পারেনি।
শুধু সামরিক শক্তিতে নয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিল বাঙালি। এই পথ ধরেই এগিয়ে চলছিল এক মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সূচনা, যার পরিণতি হয়েছিল ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণায় এবং ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে বিজয়ের গৌরবময় অধ্যায়ে।