জাতীয় সংবাদ

এনআইডি সেবায় ঘুষের নেটওয়ার্ক : লেনদেন হয় ব্যাংক ও বিকাশে

প্রবাহ রিপোর্ট ঃ স্মার্ট এনআইডি কার্ড ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবায় কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কিছু অসাধু কর্মচারীর বিরুদ্ধে। এ সংক্রান্ত বেশকিছু প্রমাণও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনে এ বিষয়ে বেশকিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে কমিশন।
সম্প্রতি, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ)’ এর আউটসোর্সিং প্রকল্পে নিযুক্ত ১৯ হাজার টাকা বেতনের এক কর্মচারীর ব্যাংক ও বিকাশ হিসাবে বেতনের বাইরে প্রায় সোয়া ২ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং বিকাশ হিসাবে ৩৬ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। একজন কর্মচারীর হিসাবে এমন অস্বাভাবিক লেনদেন হলেও টাকার উৎস সম্পর্কে পাওয়া যায়নি সন্তোষজনক কোনো জবাব। যা এখন বিভাগীয় ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
একই প্রকল্পে নিযুক্ত আরও বেশ কয়েকজন কর্মীর ব্যাংক হিসাবে নির্ধারিত হিসাবের বাইরে ১২ লাখ থেকে কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বহিরাগত দালালদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এসব লেনদেনের নেপথ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে। এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন আমলে নিয়ে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় থেকে অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত নথি ও প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গত ২৩ জুন একইরকম অনিয়মের অভিযোগে দেশের বিভিন্ন জেলার ১৩টি নির্বাচন অফিসে অভিযান চালিয়েছিল দুদক। সেই অভিযানে দুর্নীতির নানা প্রমাণ পেয়েছিল দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম।
দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন ও সংগ্রহে সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ, হয়রানি ও দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য নিয়ে প্রায়ই দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। এ নিয়ে আমাদের এনফোর্সমেন্ট টিমের অভিযানও হয়েছে বেশ কয়েকবার। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের অনুসন্ধান কর্মকর্তা আইন ও বিধি অনুসরণ করে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিলে কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুদকে দেওয়া অভিযোগ ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও বহিরাগত দালালদের বিরুদ্ধেই মূলত এমন দুর্নীতির অভিযোগ। যার মধ্যে রয়েছে– নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংশোধন, স্মার্ট এনআইডি কার্ড প্রিন্ট করাসহ জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা নিয়ে দুর্নীতি। অভিযোগ বলছে, দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কর্মরত ইসি ও ইসির প্রকল্প ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) দ্বিতীয় পর্যায়’-এর কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সেবাপ্রত্যাশীদের কাজ করে দেওয়ার বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নেওয়ার চুক্তি করেন। যার সঙ্গে জড়িত রাজধানীর বিভিন্ন কম্পিউটার দোকানি। চুক্তি অনুযায়ী এনআইডি সংশোধনের মূল দায়িত্ব পান ঢাকায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনআইডি সংশোধনে নেটওয়ার্কের সদস্যরা কখনো নিজেদের আত্মীয়স্বজন, আবার কখনো প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে ওইসব এনআইডি দ্রুত সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে হাতে হাতে ফাইল নিয়ে যান এবং অনুমোদন করিয়ে নেন। অনুমোদন হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাতে হাতে টাকা ভাগ বাটোয়ারা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক, বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টে লেনদেন করেন তারা। এভাবে কর্মচারীদের ব্যাংক ও বিকাশ একাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। ওই কর্মচারীরা ঢাকায় ফ্ল্যাট, গাড়ি ও দামি মোটরসাইকেলের মালিক বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগে আইডিইএ-২ প্রকল্পের কর্মচারী মো. বুলবুল আহমেদ, আক্তারুজ্জামান, মো. মাহবুবুর রহমান, সফিকুল, সাইফুজ্জমান, ইমরান, সজীব হোসেন, জায়দুর রহমান, আবুল কালাম পাভেল, মঈনুল গাজী, সহায়ক জুলফিকার আলী, ফকরুল ইসলাম, খন্দকার জসিম, ঈসমাইল হোসেন, জামাল হোসেন, রেজওয়ানুল হক, অফিস সহায়ক মো. নুরুজ্জামাল, অফিসের কর্মচারী নাঈম মোল্লা, ওয়াহিদুজ্জামান খান, মো. ইলিয়াস হোসেনসহ অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম উল্লেখ রয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে এনআইডিতে আইডিইএ-২ প্রকল্পে আউটসোর্সিংয়ে ২২০০-এর বেশি জনবল কাজ করছে। এছাড়া সেখানে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সশস্ত্র বাহিনী থেকে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারাও বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছেন। এনআইডি সেবায় দুর্নীতি নিয়ে ১৩ অফিসে দুদকের হানা ঃ জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন ও সংগ্রহে সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ, হয়রানি, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত ২৩ জুন দুদকের জেলা কার্যালয় থেকে একযোগে ১৩টি জেলা নির্বাচন অফিসে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানে সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ, হয়রানি ও অনিয়মের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। যেসব জেলার নির্বাচন অফিসে অভিযান পরিচালিত হয় তার মধ্যে রয়েছে– রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, নওগাঁ, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলা নির্বাচন অফিস। এর মধ্যে রংপুর জেলা নির্বাচন অফিসে দুদক টিম ছদ্মবেশে অভিযান চালায়। তারা পাসপোর্টের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানির প্রমাণ পায়। এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র ভেরিফিকেশনের জন্য সরকারি ফি ২৩০ টাকা অনলাইনে জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কিছু অসাধু কর্মচারী রশিদ ছাড়া নগদ অর্থ গ্রহণ করে ভেরিফিকেশন করছেন বলেও প্রমাণ পায় দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button