সম্পাদকীয়

করপোরেট করহারের ভার-বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা না হয়ে উঠুক

করপোরেট করহারের ভারে দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি যে চাপের মুখে পড়ছে, তা প্রাক-বাজেট আলোচনায় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যকর করপোরেট করহার শুধু তুলনামূলকভাবেই বেশি নয়, বরং বাস্তব প্রয়োগে তা আরও কঠিন এবং জটিল হয়ে উঠেছে, যা দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরুৎসাহজনক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর সঙ্গে আলোচনায় বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিসিআই, এমসিসিআই, ডিসিসিআইসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী সংগঠন করপোরেট করহার কমানোর দাবি জানিয়েছে। তাদের মতে, উচ্চ করহারের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে যা দেশের অন্যতম রপ্তানি আয়ের খাত। পোশাক খাতে বর্তমানে ১২ শতাংশ করহার এবং সবুজ কারখানার জন্য ১০ শতাংশ হার বলবৎ থাকলেও, এই হার স্থিতিশীল না থাকলে শিল্পে অনিশ্চয়তা ও আস্থার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) যেমন কোনো শর্ত ছাড়া করহার আড়াই শতাংশ কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে, তেমনি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) বলেছে, কার্যকর করহার অনেক ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এটি একটি উদ্বেগজনক চিত্র, যা কেবল কর আদায়ের কাঠামোর জটিলতাকেই তুলে ধরে না, বরং দেশের রাজস্ব নীতির বাস্তবতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। স্বয়ংক্রিয় কর রিটার্ন ব্যবস্থার অভাব, ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, এবং শর্তযুক্ত কর রেয়াতের সীমাবদ্ধতা-এসব কারণে অনেক করদাতা প্রকৃত হারে ছাড় পেলেও তা ব্যবহার করতে পারছেন না। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সঠিকভাবেই অটোমেটেড রিটার্ন ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছে, যা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বচ্ছতা ও সময় সাশ্রয়ের পাশাপাশি হয়রানি রোধে সহায়ক হবে। তবে করহার কমানোর দাবির পক্ষে যে যুক্তিটি সবচেয়ে বেশি জোরালো তা হলো-উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য প্রতিযোগিতামূলক কর কাঠামো থাকা আবশ্যক। আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগকারীরা কর কাঠামোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বিবেচনা করেন। সিপিডি-এর তথ্য বলছে, দেশের মোট রাজস্বে করপোরেট করের ভূমিকা একসময় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছালেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা হ্রাস পেয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ১৮ শতাংশে নেমে আসে, যা অর্থনীতির গতি ও ব্যবসার স্থবিরতা নির্দেশ করে। সেক্ষেত্রে করপোরেট করহারের ভারসাম্য রক্ষা করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলাই বর্তমান সময়ের দাবি। আমরা মনে করি, কর আদায়ের লক্ষ্য পূরণ এবং ব্যবসা-বিনিয়োগে উৎসাহ জোগাতে হলে সরকারকে অবশ্যই একটি সময়োপযোগী ও যুক্তিসংগত করপোরেট করনীতি গ্রহণ করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় জটিলতা, শর্তযুক্ত ছাড় এবং অস্বচ্ছতা-এসব বাদ দিয়ে একটি সরল, কার্যকর এবং প্রযুক্তিনির্ভর করব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে রাজস্ব আদায় যেমন বাড়বে, তেমনি ব্যবসায় আস্থাও ফিরে আসবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button