সম্পাদকীয়

নদীকে রুখে পথ-বাধাগ্রস্ত পরিবেশ ও অধিকার

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বেতিলা-মিতরা ইউনিয়নের সৈয়দপুর এলাকায় কালীগঙ্গা নদীর ওপর মাটি ফেলে আড়াআড়িভাবে বাঁধ নির্মাণের ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। স্থানীয়রা যানবাহন চলাচলের সুবিধার জন্য এ অস্থায়ী রাস্তাটি নির্মাণ করলেও এর ফলে নদীর পানিপ্রবাহে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। জলজ জীববৈচিত্র্য, পানি ব্যবহারের উপযোগিতা ও স্থানীয় পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। পত্রপত্রিকার খবরাখবর থেকে জানা গেছে, উত্তর পাড়ের আউটপাড়া ও দক্ষিণ পাড়ের সৈয়দপুর এলাকাকে যুক্ত করতে নদীর ওপর মাটি ফেলে এই সড়ক তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে পানিতে ময়লা-আবর্জনা জমছে, মাছ মারা যাচ্ছে এবং পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। নদীতে গোসল করলেই এখন শরীর চুলকায় বা জ্বালা করে, এমন অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। এটি যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও জলাধার সংরক্ষণ আইনের সরাসরি লঙ্ঘন, তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন। তবে সমস্যার গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি কেবল একটি পরিবেশবিষয়ক ইস্যু নয়, বরং এটি একটি অবকাঠামোগত বঞ্চনার ফলাফল। দীর্ঘদিন ধরে একটি সেতুর অভাবে দক্ষিণ পাড়ের বাসিন্দারা শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণসহ নানা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। খেয়া পারাপারে ভোগান্তি, মাঝির অনুপস্থিতি এবং ঝড়বৃষ্টিতে জীবনহানির মতো ঘটনা তাদেরকে এই আত্মঘাতী পথে ঠেলে দিয়েছে। স্থানীয়দের ভাষায়, তারা বছরের পর বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছেন একটি সেতুর জন্য, কিন্তু পদক্ষেপের অভাবে শেষ পর্যন্ত নিজেরাই বিকল্প পথ গড়েছেন। এখানেই প্রশ্ন ওঠে-এমন মানবিক দুর্দশা কি রাষ্ট্রের নজর এড়িয়ে গেছে? প্রকৃত অর্থে, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না করে যখন জনগণ আইন ভেঙে সমাধান খোঁজে, তখন তার দায় প্রশাসনও এড়াতে পারে না। যদিও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বাঁধ অপসারণের আশ^াস দিয়েছেন, প্রশ্ন থেকে যায়-এটি কি শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব, না কি প্রয়োজন একটি টেকসই, মানবিক ও পরিপূর্ণ সমাধান? আমরা মনে করি, এ মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত- কালীগঙ্গা নদীর ওপর গড়ে ওঠা অবৈধ বাঁধ দ্রুত অপসারণ করে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে; এলাকার পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন করে পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নিতে হবে; এবং সৈয়দপুর ও আউটপাড়ার মধ্যে একটি স্থায়ী সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিতে হবে, যাতে মানুষ বাধ্য হয়ে আর কখনো নদী হত্যা করে চলাচলের পথ না খোঁজে। নদী আমাদের প্রাণ ও প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ অবহেলার কারণে আজ তা ধ্বংসের মুখে। সময় থাকতে হুঁশিয়ার না হলে, এমন ঘটনা ভবিষ্যতেও শুধু মানিকগঞ্জেই নয়, দেশের অন্যত্রও ঘটতে থাকবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button