খুলনায় প্রচন্ড শীতে ৬ জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
খুলনায় হাড় কাঁপানো শীতে কাতর শিশু-বয়স্করা হাসপাতালে নেই তিল ধারণের ঠাঁই
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান ও এম এ আজিম : তীব্র শীতের কারণে খুলনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিকে, স্কুলগুলোতে বন্ধের নির্দেশনা পৌঁছানোর আগেই বহু শিক্ষার্থী স্কুলে গিয়ে ছুটির কথা জানতে পেরে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে। খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম জানান, তীব্র শীতের কারণে খুলনা মহানগরীসহ জেলার ১ হাজার ১৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া তীব্র শীতের কারণে খুলনা বিভাগের যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে মোবাইল ফোনের খুদে বার্তার মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলোর প্রধানকে বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাছাড়া সকাল ১০টায় বিদ্যালয়গুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আবহাওয়ার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। তবে নির্দেশনা দিতে দেরি হওয়ায় সাতক্ষীরায় মঙ্গলবার ছুটি দেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি। অপরদিকে, খুলনা বিভাগীয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উপপরিচালক খো. রুহুল আমিন জানান, তীব্র শীতের কারণে খুলনা বিভাগের খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবহাওয়া বিবেচনা করে বুধবার এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আমিরুল আজাদ জানান, মঙ্গলবার খুলনায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা খুলনায় চলতি বছরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। নিউমোনিয়া আক্রান্ত ছোট আরাফাতকে নিয়ে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে খুলনার শিশু হাসপাতালে ছুটে এসেছেন মা-বাবা। তারা চিন্তিত শিশু সন্তানকে নিয়ে। এভাবে আরাফাতের মতো ঠান্ডা জনিত রোগে বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি রয়েছে হাজারো রোগী। শীত বাড়ার সাথে সাথে নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে তারা। এদিকে, খুলনায় তীব্র শৈত্য প্রবাহে ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্ট জনিত নিউমোনিয়াসহ নানা রোগবালাই প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিল ধারনণর ঠাঁই নেই খুলনার হাসপাতালগুলোতে। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ঠান্ডাজনিত রোগে। ইতিমধ্যেই মঙ্গলবার খুলনায় তাপমাত্রা ৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসায় জেলার সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা দপ্তর। খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ অহিদুল আলম এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ফারহানা নাজ আলাদা বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির উপরে না ওঠা পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। আবহাওয়া স্বাভাবিক (১০ ডিগ্রি) না হওয়া পর্যন্ত খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া- এ ৫টি জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো.মোসলেম উদ্দিন। অপরদিকে, খুলনা বিভাগীয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উপপরিচালক খো. রুহুল আমিন জানান, তীব্র শীতের কারণে খুলনা বিভাগের খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবহাওয়া বিবেচনা করে বুধবার এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আমিরুল আজাদ জানান, মঙ্গলবার খুলনায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা খুলনায় চলতি বছরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এ অবস্থায় চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতিবারই শীত মৌসুমে আক্রমণ করে ঠান্ডাজনিত নানা রোগ। তবে বেশি বাড়ে শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এ ছাড়াও নিউমোনিয়ার সমস্যা বড় হয়ে ওঠে শিশু ও বয়স্কদের জন্য। এতে মৃত্যুও ঘটে। শীতের আবহাওয়া শুষ্ক, ধুলাবালির মাত্রাটাও কিছুটা বেড়ে যায়। এ কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। তাই এ সময়ে ঠান্ডা খাবার ও পানীয় পরিহার করা, কুসুম কুসুম গরম পানি পান করা এবং হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা উচিত। আর প্রয়োজনমতো গরম কাপড় পরাও জরুরি। তবে খুব বেশি জ্বর, গলাব্যথা, কাশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। উন্নত চিকিৎসার আশায় দক্ষিণাঞ্চলের ১২ জেলার শিশুদের অন্যতম আশ্রয়স্থল খুলনার আড়াইশ শয্যা’র শিশু হাসপাতাল। গেল কিছুদিন ধরে হঠাৎ ঠান্ডা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে শীত জনিত জটিল রোগের প্রকোপ। তবে স্থান সংকুলানের অভাবে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ নতুন রোগী ভর্তি করতে পারছেনা। সেবা দিতে হিমসিম খাচ্ছে সেবিকারাও। আবার অতিরিক্ত রোগী আসায় বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিয়েও ফিরে যেতে হচ্ছে শিশুদের। এ হাসপাতালে প্রতিদিন ৫শ’ থেকে ৭শ’ রোগীকে বহির্বিভাগের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, জেঁকে বসা তীব্র শীতে বেশি বিপাকে পড়েছেন ছিন্নমূল ও খেটে খাওয়া মানুষরা। শীতের প্রকোপে রোগীর চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। বেশি রোগাক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। শীতের এমন তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কোল্ড ডায়রিয়া ও ঠা-াজনিত বা শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ। এ অবস্থায় ডায়রিয়া রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে খুলনার হাসপাতালগুলো। প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছে শতাধিক রোগী। বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে প্রতিদিন রোগির সংখ্যা বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ড না থাকায় রোগীদের মেঝে ও বারান্দায় বিছানা পেতে থাকতে হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং চিকিৎসকদের সূত্র জানিয়েছে, শীতের সময় ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন রোগী চিকিৎসা নেয়। কিন্তু এই শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলে এই সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলো শয্যা সংকটের কারণে অনেককে মেঝে ও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এছাড়া হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে অনেকে বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। খুলনা শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বহির্র্বিভাগে শিশু রোগি এবং অভিভাবকের পদচারণায় ওই ফ্লোরে তিল ধারণের ঠাই নেই। প্রতিদিন প্রায় ৬শ’ শিশু এ হাসপাতালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়। প্রায় ৬শ’। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রূপসা উপজেলার মো. আকরাম হোসেন জানান, আমার ছেলের বয়স আড়াই বছর। পাতলা পায়খানা হচ্ছে। নাক দিকে অঝরে পানি ঝরছে। তাই ডাক্তারের কাছে আনছি। ডাক্তার বলেছে, কোল্ড ডায়রিয়া হয়েছে। তবে ভয় নেই। খুলনা শিশু হাসপতালে সন্তানকে নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা বটিয়াঘাটা এলাকার মোসা. আফরোজা খানম জানান, মেয়েটা বমি করছে। একইসাথে পাতলা পায়খানাও। আস্তে আস্তে কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিলে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেছেন। তাই হাসপতালে আসলাম। এখানে ডাক্তার দেখেছে। ডাক্তার বলেছে, অতিরিক্ত ঠা-ার জন্য এমন হয়েছে। তবে হাসপাতালে ভর্তির কোন সিট নেই। শিশু রোগীর একজন অভিভাবকরা জানান, মাগুরা জেলা থেকে বাবুর শ্বাসকষ্ট ও হাপানি নিয়ে এসেছেন। এছাড়া একটু ওজন কম হিওয়ায় ইনকিউভিটর মেশিনের ভীতর রাখা হয়েছে। হাসপাতালের একজন সেবিকা (নার্স) বলেন, আমরা অনেক সময় রোগীর সিট দিতে পারিনা, তারপরও চেষ্টা করি শিশুর চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এ কে মামুনুর রশীদ জানান, শীত বাড়ার কারণে শিশুদের ডায়রিয়া এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। এসময় শিশুদের প্রতি বিশেষ কেয়ার রাখতে হয়। যাতে কোন ধরণের ঠান্ডা না লাগে। খাবারেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। আর কোল্ড ডায়রিয়া হলে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। ঠা-া না লাগে সেদিকে নজর লাকতে হবে। সর্বপরি শিশুর কোন ধরণের সমস্যা মনে হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। খুলনা শিশু হাসপাতালের আরএমও ডা. সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, হঠাৎ করে ঠান্ডা পড়ায় শিশু রোগ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কোল্ড ডায়রিয়া এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগ। এসময় শিশুদের প্রতি বাড়তি খেয়াল রাখতে হয়। শিশুদের সর্দি কাশি হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জামাকাপড় পরিস্কার রাখতে হবে। ডাস্ট থেকে দূরে রাখতে হবে শিশুকে। ধূলাবালি পাশে যেন না যায় বা দূরে রাখা। শিশুর খাবার বিষয়ে বিশেষ সতর্ক রাখতে হবে। খুলনা শিশু হাসপাতালে ২৭০ জন শিশু রোগি ভর্তি করতে পারি। আমাদের সব সিটে রোগি রয়েছে। ফলে আমরা নতুন করে কোন রোগি ভর্তি করতে পারছি না। তবে প্রতিদিন সুস্থ হয়ে যেসব রোগি বাড়ি ফিরছে। সেই সিট খালি হলে সেখানে রোগি ভর্তি করতে পারছি। খুলনা শিশু হাস্পাতালের তত্বাবধায়ক ডা. কামরুজ্জামান জানান, আউটডোরে প্রায় প্রতিদিনই ৪’শত থেকে ৬’শত রোগী থাকে এবং কোন আরও বেশি হয়ে যায়। সর্দিকাশি ও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগীরা বেশি আসে। অপরদিকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, ‘বর্তমানে এই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ৭০-৮০ ভাগই শীতজনিত কারণে অসুস্থ। তাদের বেশির ভাগই শিশু ও বৃদ্ধ। এ হাসপাতালে এখন দৈনিক ১৫০০-১৬০০ রোগী ভর্তি হচ্ছে। আবার শীতজনিত কারণে মারা গেলেও পরিসংখ্যান ওইভাবে করা সম্ভব হয় না। কারণ, শীতের কারণেই রোগীর অ্যাজমা সমস্যা বাড়ে, কাশি বাড়ে, জ্বর থেকে নিউমোনিয়া হয়। কিন্তু মারা গেলে এসব রোগই শনাক্ত করা হয়। তখন তা শীতজনিত কারণে বলা সম্ভব হয় না।’