স্থানীয় সংবাদ

খুলনায় অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বহাল তবিয়তে : নেই আশানুরূপ অভিযান

শুধুমাত্র ক্লিনিকের লাইসেন্স নিয়ে ডায়াগনষ্টিক সেন্টার আবার ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নিয়ে ক্লিনিক চলছে

কামরুল হোসেন মনি ঃ খুলনা মহানগরীতে অলিগলিতে চিকিৎসাসেবার নামে অবাধে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে অসংখ্য অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে অনেকটা চোর-পুলিশ খেলা চলছে। অভিযানে অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনিস্টিক সেন্টার তালাবদ্ধ করা হলেও পরদিন তা আবার চালু হয়ে যায়। খুলনায় এমনও নজির রয়েছে। গত ১৭ জানুয়ারি হরিনটানা থানাধীন এলাকায় খুলনা র‌্যাবের পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালত দুটি প্রতিষ্ঠানকে অর্থদন্ড প্রদান করেন। অভিযানে ছফুরা ক্লিনিক ও মোহাম্মাদনগর হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা প্রদান করেন। এর পরে আর অভিযান হয়নি। যার কারণে ওই সব অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টার ও নবায়ন নেই এমন প্রতিষ্ঠান চলছে বহাল তবিয়তে। খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, খুলনা শহরে ২৭০ টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। এর মধ্যে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নবায়ন রয়েছে এমন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৯৮টি । এছাড়া নবায়ন হয়নি এমন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা আছে ১৫৭টি। এর মধ্যে ডায়াগণস্টিক সেন্টার ১০২টি এবং ক্লিনিক আছে ৫৫টি। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের এক বছরের, কারো ২ বছরের কারো বা ৩ বছরের আবার কেউ ৪ বছরেও কোন নবায়ন করেননি। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, নগরীতে শুধুমাত্র অনলাইনে আবেদনের ওপরই অনেকেই বছরের পর বছর ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনা করছেন কিন্তু লাইসেন্স নেই এমন অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে ১৪টি । এর মধ্যে রয়েছে বয়রা সেন্ট্রাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বয়ো ল্যাব ডায়াগণস্টিক সেন্টার এ- কনসালটেশন সেন্টার, নূরজাহান ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার, কালিয়া ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কালিয়া ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পাল্প ডেন্টাল সেন্টার, স্বাস্থ্য সেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগণস্টিক সেন্টার, স্বাস্থ্য সেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগণস্টিক সেন্টার, মাই মেডিকেল ল্যাব ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার, জেনারেল ডায়াগণস্টিক এন্ড রির্সোস সেন্টার, বেস্ট কেয়ার ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার-১, বেস্ট কেয়ার ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার-২, রহিমা ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার এবং শাবাব ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার। এছাড়া মকোন আবেদন ছাড়াই এমন লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টার রয়েছে ১০টি। এর মধ্যে খুলনা শিশু হাসপাতাল ( ক্লিনিক), খুলনা শিশু হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ( ডায়াগনস্টিক), খুলনা ডায়াবেটিক হাসপাতাল, ডায়াবেটিক সমিতি খুলনা (ডায়াগনস্টিক), সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক-১ (ডায়াগনস্টিক), সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক-২ (ডায়াগনস্টিক), জাপান মেডিকেল সেন্টার (খুলনা শাখা-১) এবং নিউ পথ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ অনেক ক্লিনিকে রোগীরা অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রোগ নির্ণয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী বলেছেন, অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে। মাঝে মাঝে অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে অনেক প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হয়, করা হয় জরিমানা। তারপরও অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য কমছে না কেন সেটা একটা প্রশ্ন। অভিযোগ আছে অনেক সরকারি হাসপাতালে মানসম্মত চিকিৎসা মেলে না। আবার চিকিৎসা ভালো হলেও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রোগীবান্ধব নয়। যে কারণে অনেক মানুষ বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিভর্র করেন আর এই সুযোগটিই নেয় একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। তারা চিকিৎসাসেবা দেয়ার নামে গড়ে তোলে ‘বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান’। আর এক্ষেত্রে অনেকেই কোনো নিয়ম-নীতির ধার ধারেন না। লাইসেন্সবিহীন এসব প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, অবৈধ ক্লিনিকগুলোর কোনটি ক্লিনিকের লাইসেন্স নিয়ে এর সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কোনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে এর সঙ্গে ক্লিনিক পরিচালনা করে এসেছে। আবার কোনোটি শুধু লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে সে কপি ডেস্কের সামনে ঝুলিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী দেখেন সরকারি চিকিৎসকরা। একাধিক সূত্রর দাবি, বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক হাসপাতালে অনেক রোগীর সিজার দরকার নেই, কিন্তু তারপরও সিজার হচ্ছে। নবজাতক শিশুকে টেনেহিঁচড়ে বের করা হচ্ছে। সিজার করতে গিয়ে বিভিন্ন অঙ্গহানির ঘটনাও ঘটছে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো অনেকটা কসাইখানার মতো। অনেক ক্লিনিকে বসেন ভুয়া ডাক্তার। আবার বিশেষজ্ঞ কোনো ডাক্তার থাকে না। মেডিকেল অফিসার আছেন। তাদের ভুল চিকিৎসায় অনেকে মারা গেছেন। এসব ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো টাকা বেশি নিলেও সেবার মান খুবই নিম্নমানের। কোটি কোটি টাকা তারা কামিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ তাদের কিছুই করতে পারছে না। স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, একটি হাসপাতাল পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বৈধ সনদ, নিয়মিত নবায়ন, নারকোটিক পারমিট (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), পরিবেশ ছাড়পত্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ক্ষতিকর ও অক্ষতিকর) কাগজপত্র সত্যায়িত করে সংরক্ষণ করতে হবে, যা পরিদর্শনকালে নিরীক্ষা করতে হবে। বিশেষ সেবার ক্ষেত্রে প্রতিটির শয্যা সংখ্যা, সেবা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কর্তব্যরত চিকিৎসকের নাম ও কর্তব্যরত নার্সদের নাম-ঠিকানা, ছবি, বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন, বিশেষজ্ঞ সনদ, নিয়োগ ও যোগদান বা সম্মতিপত্র লাগবে। চিকিৎসা সাহায্যকারীদের তালিকা, যন্ত্রপাতির তালিকা, বর্তমানে যেসব অস্ত্রোপচার ও যন্ত্রপাতির তালিকা হাসপাতাল প্রধানের স্বাক্ষরসহ সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই এসব শর্ত শতভাগ মানা হচ্ছে না। খুলনা সিভিল সার্জন ডা: সবিজুর রহমান বলেন, অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টারের ব্রিুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে ২-৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। খুলনা জেলা প্রশাসকের সহকারি কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো: মাসুম বিল্লাহ এ প্রতিবেদককে বলেন, নগরীতে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগণস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাবো সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা হবে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৮২ সালের মেডিক্যাল অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর সুযোগ নেই।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button