নগরীতে ইজিবাইক এখন গলার কাটা : রাস্তার মাঝে থামে চাকা
বৈধর চেয়ে অবৈধ ইজিবাইকের সংখ্যা তিনগুন
এশিয়ায় অননুমোদিত যান চলাচলে শীর্ষে খুলনা
কামরুল হোসেন মনি ঃ নগরীর সড়ক মহাসড়কগুলো এখন ইজিবাইকের দখলে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নগরীর অলিগলি। এর প্রকৃদ সংখ্যা কেউ জানে না। তবে ইজিবাইক চালকের ভাষ্য অনুযায়ী নগরীতে ২০-২৫ হাজার ইজিবাইক চলাচল করে। যদিও যানজট কমানো ও অবৈধ ইজিবাইক চলাচলের বন্ধে দু’বছর আগে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নগরীতে চলাচলের জন্য ৭ হাজার ৯৯৬ টি লাইসেন্স প্রদান করা হয়। সেই সাথে নম্বর প্লেট ও স্টিকার দেওয়া হয়। পরে নবায়নের বাইরে থাকা ইজিবাইকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে কেসিসি এমন সিদ্ধান হয়েছিলো। কিন্তু এখন কেসিসি’র কর্তৃপক্ষ বলছে এই অভিযানের দায়িত্ব পুলিশকে ( ট্রাফিক) দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে খুলনা মেট্রোপলিন পুলিশ (কেএমপি’)র ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মনিরা সুলতানা বলেন, খুলনা সিটি কর্পোরেশন থেকে ১০ ইজিবাইক এর লাইসেন্স প্রদান করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ইজিবাইক বিভিন্ন পন্য পরিরহনের জন্য। তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করছি। কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই তাদেরকে জরিমানা করা হচ্ছে।
কেসিসির লাইসেন্স (যানবাহন) কর্মকর্তা রবিউল আলম বলেন, ২০১৯ সালে কেসিসি নগরীতে অনুমোদন নিয়ে চলাচলের জন্য ১০ হাজার ফরম বিতরণ করে। সে মোতাবেক ইজিবাইকের মালিকেরা ফরম পূরণ করে কেসিসির লাইসেন্স শাখায় জমা দেন। যাচাই-বাছাই শেষে কর্তৃপক্ষ প্রায় ৮ হাজারটি অনুমোদন (লাইসেন্স) দেয়। এদেরকে নম্বর প্লেট ও স্টিকার প্রদান করা হয়েছে। এসব ছাড়া ইজিবাইক নগরীতে চললে সেটাকে অবৈধ গণ্য করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে পুলিশ। কারণ এই অভিযানের দায়িত্¦ পুলিশকে দেওয়া হয়েছে বলে তার দাবি।
সরেজমিন দেখা যায়, শিল্পনগরী খুলনা এখন অঘোষিত ইজিবাইকের নগরীতে পরিণত হয়েছে। মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও এলাকায় যানজটে নাকাল নগরবাসী। যার মধ্যে নগরীর শিববাড়ি মোড় যা এখন ইজিবাইকদের অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ডের রূপ নিয়েছে। এছাড়া রূপসা, সাতরাস্তার মোড়, রয়েল চত্বর, ক্লে রোড, স্যার ইকবাল রোড, শামসুদ্দিন আহমেদ রোড, সাউথ সেন্ট্রাল রোড, খানজাহান আলী রোড, স্টেশন রোড, বড় বাজার রোড, কোর্ট চত্বর, গগনবাবু রোড, ডাকবাংলা, নিউমার্কেট, ময়লামোতা মোড়, গল্লামারী, নিরালা, বয়রা, সোনাডাঙ্গা, খালিশপুর, দৌলতপুর, ফুলবাড়ীসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এখন অনিয়ন্ত্রিত ইজিবাইকের দখলে। ছুটির দিন ছাড়া নগরীর বেশকিছু সড়কে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে।
ইজিবাইক চালকের সাথে কথা বলে জানা যায়, খুলনা নগরীতে তিন চাকার ব্যাটারি চালিত ইজিবাইকের দাপট বেড়েই চলছে। এসব চালকদের ভাষ্য অনুযায়ী নগরীতে ২৫-৩০ হাজার ইজিবাইক চলাচল করছে। এর মধ্যে কেসিসি’র অনুমোদিত মাত্র ৮ হাজার লাইসেন্সধারী ইজিবাইক চলাচল কছে। বৈধ চেয়ে অবৈধ ইজিবাইকের চলাচল বেশি। সারা শহরে এখন অল্প ব্রেকের এই যান চলাচল করছে অবাধে। মানছে না কোনো বিধি নিষেধ। যেখানেই যাত্রীর ডাক পড়ে সেখানেই থামে এই যান। হোক রাস্তার মাঝে বা পাশে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বেড়েই চলছে এই তিন চাকার ইজিবাইকের সংখ্যা। এতে চলাচলে কোনো শৃঙ্খলা থাকছে না। যে যার ইচ্ছা মতো এসব যান চালাচ্ছে। এতে প্রতিদিন শহরে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে ইজিবাইকগুলো। অদক্ষ চালকের কারণে যেখানে-সেখানে ইউটার্ন নেয়া ও যাত্রী ওঠানো-নামানোতে প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। ইজিবাইকের দৌরাত্ম্যের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে খুলনা সিটি কর্পোরেশন উদ্যোগ নিলেও সাধারণ মানুষের মুক্তি মেলেনি ভোগান্তি থেকে। ইজিবাইক চালক মো: মোস্তফা অপু জানান, ইজিবাইকের লাইসেন্স করতে তার সাড়ে ১০ হাজার টাকা সিটি কর্পোরেশনকে প্রদান করতে হয়েছে। এখন তো লাইসেন্স ‘ভাড়ায়’ পাওয়া যায়। প্রতিদিন ২০০ টাকা। তিনি বলেন, এখন ইজিবাইকের লাইসেন্স সোনার হরিনের মতো দায়িয়েছে। কেউ লাইসেন্স বিক্রি করলে সর্বোচ্চ ৯০ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। ইজিবাইক আমিনুল ইসলাম জানান, অবৈধ ইজিবাইক চলাচলের বন্ধের জন্য খুলনা সিটি কর্পোরেশন আমাদেরকে নম্বর প্লেট ও স্টিকার প্রদান করছে। তারপরেও নগরীতে চলছে অবৈধ ইজিবাইক। লাইসেন্সধারীরা তো চলছে, সাথে অবৈধরাও। অবৈধভাবে চলাচল করা পুলিশের হাতে আটক হলে ১ হাজার ৬০০ টাকা জরিমানা করেন। এই টাকার স্লিপও দেন। তবে দেনদরবার করে ৫০০ টাকায় ছাড়ায় নিলে ওই টাকার স্লিপ দেন না। তবে পরের দিন ওই ইজিবাইক আবারও আটক হলে আবারও ৫০০ টাকা দেওয়া লাগছে। অফিস টাইম শেষ হওয়ার পরে কিছু মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ এ অভিযান চালান। একাধিক ইজিবাইক চালকরা জানান সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশের কিছু কর্মকর্তার উদাসীনতার কারণে নগরীতে অবৈধ ইজিবাইকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রতিটি মোড়ে কিছু ট্রাফিক পুলিশকে এরা মাসোয়ারা দেয়। এ কারণে তারা ইজিবাইকের কাগজপত্র না দেখে ছেড়ে দেয়। একটি গাড়ির বৈধ কাগজের অনুকূলে একাধিক ইজিবাইক চলছে বলে তাদের অভিযোগ।
অফিসগামী পথচারী ও যাত্রীদের অভিযোগ, যত্রতত্র পার্কিং, চালকদের যাত্রী নেয়ার প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, অতিরিক্ত লাইসেন্সবিহীন ইজিবাইকের চলাচলসহ বেশকিছু কারণে বাড়ছে যানজটসহ ভোগান্তি। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যেপৌঁছাতে পারে না শিক্ষার্থীরা। কেসিসির পক্ষ থেকে নগরীর প্রধান প্রধান সড়কে ইজিবাইকের সংখ্যা ও রূট নির্ধারণ করা হলেও তার কোনো তোয়াক্কাই নেই। পাশাপাশি শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার বিষয়টি যাদেও দেখার কথা তাদের ভূমিকা সম্পূর্ণ নীরব। বেসরকারি চাকরিজিবী রবিউল হক বলেন, শহরে ইজিবাইক চালকদেও কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যেভাবে পারছে ইজিবাইক চালাচ্ছে। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। আমার সন্তন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে একা একা রাস্তা পার হতে পারে না। ভয় পায়। এখনও তাকে রাস্তা পার করে দিতে হয় এই ইজিবাইকের জন্য। আবার যেখানে স্টপেজ না সেখানে যে কেউ হাত ইশারা করলে থেমে যাচ্ছে ইজিবাইক চালকেরা। এতে পেছনে থাকা অন্যান্য গাড়ি তাল সামলাতে না পারায় ঘটছে দুর্ঘটনা। এশিয়ায় অননুমোদিত যান চলাচলে শীর্ষে খুলনা : দেশে ২০ ধরনের যানবাহন চলাচলের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে অনুমোদনের বাইরে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরো বেশ কয়েক ধরনের যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের মধ্যে রয়েছে রিকশা, স্কুলভ্যান, ইজিবাইক, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের থ্রি-হুইলার কিংবা ঘোড়ার গাড়ির মতো অননুমোদিত যানবাহন। এর পাশাপাশি চলাচলের অনুমতি থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা ও প্রাইভেটকারের মতো যানবাহনও সড়কে চলছে। জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (এসকাপ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই এমন যানবাহন (ইনফরমাল ট্রান্সপোর্ট) চলাচলে এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের দুটি শহর খুলনা ও ঢাকা। এর মধ্যে খুলনা শহরে যত যানবাহন চলে তার ৫৮ শতাংশেরই কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই। আর রাজধানীতে অননুমোদিত পরিবহনের পরিমাণ ৫৪ শতাংশ। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা (৫০ শতাংশ), ফিলিপাইনের ম্যানিলা (৩৮ শতাংশ), ভারতের সুরাট (৩০ শতাংশ), ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং (১৭ শতাংশ), কম্বোডিয়ার নমপেন (১২ দশমিক ৪ শতাংশ), ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়া (১১ শতাংশ) ও ভারতের জয়পুর (১১ শতাংশ)। ২০২৩ সালে মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘সাব-রিজিওনাল মিটিং অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ওয়ার্কশপ অন এক্সিলারেটিং দ্য ট্রানজিশন টু ইলেকট্রিক মোবিলিটি ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক এক কর্মশালায় ঐ প্রতিবেদনের এসব তথ্য উপস্থাপন করেন ইউএন-এসকাপের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তা মদন বি রেগমি। তিনি বলেন, এশিয়া মহাদেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে ‘ইনফরমাল ট্রান্সপোর্ট’ চলাচলে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের খুলনা। শহরটিতে ইনফরমাল ট্রান্সপোর্টের ‘মোড শেয়ার’ ৫৮ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকার ‘মোড শেয়ার’ ৫৪ শতাংশ।