স্থানীয় সংবাদ

আটকে গেছে ৩শ’ কোটি টাকার হিমায়িত চিংড়ির শিপমেন্ট

ক্ষতি ১শ’ কোটি টাকা

ইন্টারনেট সেবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসায় প্রায় ২০০ টন হিমায়িত চিংড়ি শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান ঃ করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই কোটা আন্দোলন ঘিরে চলমান সংকটে দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য হিমায়িত চিংড়ি সেক্টরে নেমে এসেছে বড় ধরণের বিপর্যয়। এদিকে ইন্টারনেট সেবা বিঘিœত হওয়ায় বন্ধ রয়েছে শিপমেন্ট, অন্যদিকে রপ্তানিযোগ্য চিংড়ির কনটেইনার টানা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আটকে থাকায় বিপুল অর্থ লোকসান গুণতে হচ্ছে রপ্তানিকারকদের।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফই) সূত্র বলছে, ইন্টারনেট সেবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসায় প্রায় ২০০ টন হিমায়িত চিংড়ি শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। যার মূল্য ৩০০ কোটি টাকা। ১০ দিন ধরে রপ্তানিযোগ্য এসব চিংড়ির কনটেইনার আটকে রয়েছে। ফলে ১০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন রপ্তানিকারকেরা। এ তথ্য নিশ্চিত করে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফই) প্রেসিডেন্ট কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, ইন্টারনেটের অচলাবস্থার কারণে সব সেক্টরে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি ব্যাংকের মাধ্যমে ক্রেতাদের টাকা পাঠানো হলেও অ্যাকাউন্টে ঢুকছে না। পুরোপুরি নেট ঠিক না হওয়ায় ব্যাংকের সার্ভারগুলো ধীরগতিতে কাজ করছে। রফতানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঘেরে পর্যাপ্ত মাছ আছে। কিন্তু ক্রেতা নেই। বিক্রি করতে না পারায় মাছের জন্য প্রতিদিন অতিরিক্ত খাবার জোগাতে হচ্ছে। ফলে লোকসান বাড়ছে। কেউ কেউ ঘেরকে চিংড়ি পোনা ছাড়ার উপযোগী করতে বাধ্য হয়ে অর্ধেক দামে মাছ বেচে দিচ্ছেন। তারাও গুণছেন লোকসান। অন্যদিকে সরবরাহ কমের অজুহাতে মাছ চাষের উপকরণের দাম বাড়ায় আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছেন চাষিরা। খুলনার খামারি জাকির হোসেন বলেন, ‘কোটা আন্দোলন ঘিরে এই সংকটে পড়তে হয়েছে খামারিদের। দোকানে গিয়ে চিংড়ির খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। এখনও খাবার সরবরাহ ঠিক হয়নি। ফলে বেশি দামে খাবার কিনতে হচ্ছে। আবার মাছও বিক্রি করা যাচ্ছে না। কারণ রফতানি বন্ধ আছে।’ খুলনার মডার্ন সি ফুড ও ব্রাইট সি ফুডের সেলস ম্যানেজার সাইফুদ্দিন তনু জানান, চলমান সংকটের কারণে তাদের দুটি প্রতিষ্ঠানের চার কনটেইনার চিংড়ি শিপমেন্টের অপেক্ষায় রয়েছে । চার কনটেইনারে ৮০ টন রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি রয়েছে; যার মূল্য প্রায় ৮০ কোটি টাকা। তবে গত বুধবার থেকে ইন্টারনেট চালু হলেও নেটের গতি কম এবং মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্কে সমস্যার ফলে সংকট কাটছে না। এদিকে, বেনাপোলের কাস্টমস অ্যান্ড ক্লিয়ারিং এজেন্ট মেসার্স মিলন এন্টারপ্রাইজের পক্ষে রজলুর রহমান জানান, সাম্প্রতিক অচলাবস্থায় তাঁদেরও সংকটে পড়তে হয়েছে। বেনাপোলের ভারতীয় অংশে পেট্রাপোলে এক সপ্তাহ ধরে পড়ে ছিল ৫০ টন চিংড়ির খাবার। বুধবার ওই খাবারগুলো বেনাপোল সীমান্ত পার হয়ে দেশে ঢুকেছে।
এ বিষয়ে খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, সাম্প্রতিক অচলাবস্থার ফলে শুধু ব্যাংকে লেনদেনে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে রপ্তানিকারকদের। ইন্টারনেট চালু হওয়ায় এখন আর সে সংকট থাকবে না। তবে খুলনার চিংড়ি উৎপাদনকারীদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, করোনায় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ইউরোপ-আমেরিকায় চিংড়ি রপ্তানি কমে যায়। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ভেনামি (প্রশান্ত মহাসাগরীয় চিংড়ির একটি প্রজাতি) চিংড়ির চাহিদা বেশি থাকায় প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না দেশি বাগদা ও গলদা চিংড়ি। এ ছাড়া নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে চিংড়ি চাষেও আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ১৮ কোটি ৩২ লাখ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে ২০ শতাংশের বেশি।
মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৭১ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১৩ হাজার ২৭১ টন। অর্থাৎ প্রায় ৩ হাজার টন রপ্তানি কম হয়েছে।
জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে চিংড়ি খাতে এই মন্দা চলছে। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে।
বিএফএফইএর পরিচালকএস হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা চিংড়ির যথাযথ মূল্য পাচ্ছি না। ফলে দেশের চিংড়িচাষিরা উৎপাদন খরচ ওঠাতে পারছেন না।’ তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা ৭৮ শতাংশ। সেখানে বাগদা চিংড়ির বাজার ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। আর গলদা চিংড়ির বাজার মাত্র ৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে গেলে ভেনামি চিংড়ি চাষের বিকল্প নেই।
ফিশ ফার্ম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি মোল্লা শামসুর রহমান শাহীন বলেন, প্রাকৃতিক চিংড়ির উৎপাদন কমে গেছে। চাষের চিংড়ি তেমন কমেনি। রপ্তানি কমায় চাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে চিংড়ি চাষ থেকে অনেক চাষি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তিনি বলেন, চিংড়ি খাতে সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন রপ্তানিকারকেরা, চাষি পর্যায়ে কোনো সুবিধা সরকারের নীতিমালায় নেই। তিনি আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় চিংড়ির ব্র্যান্ডিং করার ওপর জোর দেন।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button