স্থানীয় সংবাদ

নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতে হয় ১৩ বছরের এতিম মাহিনুরের

বি. এম. জুলফিকার রায়হান, (তালা) প্রতিনিধি ঃ মাত্র ১৩ বছর বয়সের পিতৃহীন জীবন মাহিনুর রহমান বায়েজিদের। সংসার চালাতে তাকে নদীতে মাছ ধরে এবং কাঁকড়ার পয়েন্টে কাজ করতে হয়। কাজের মধ্যেও সে ব্রিজ স্কুলে পড়তে ভালোবাসে। ছোটবেলাটা বেশ ভালোই ছিল মাহিনুরের। মাত্র আট বছর বয়সে বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এখন সে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়াালিনী ইউনিয়নে দাতিনাখালী গ্রামে দাদা-দাদীর সাথে থাকে। বাবার মৃত্যুর পর ২ বছর বয়সের ছোট বোনকে রেখে মা অন্য জায়গায় বিয়ে করে। সেই থেকে মাহিনুর ও তার বোন বৃদ্ধ দাদা দাদীর সাথে বসবাস করে আসছে। দাদা আমিন গাজীর বাম হাত নাই। একটি হাত নিয়ে তিনি নদীতে বাগদা মাছের রেনু ধরে সংসার খরচ নির্বাহ করেন। মাহিনুরও তার দাদার সাথে নদীতে মাছ ধরত। বর্তমানে দাদা দাদীর বয়স বেড়েছে। ছোট বোনটি এখন বড় হচ্ছে। পরিবারের খরচ বৃদ্ধি পেলেও আয় করার কেউ নেই। তাই বর্তমানে সে নদীতে মাছ ধরার পাশাপাশি কাঁকড়ার পয়েন্টে কাজ করে। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, মাত্র ৬ বছর বয়সে বাবা মাহিনুরকে স্থানীয় কলবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেয়। দুই বছর সে ভালো লেখাপড়া করে। কিন্তু বাবা মারা যাওয়া ও মা অন্যত্র চলে যাওয়ার কারণে ২য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর সে আর লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি। ২০২২ সালে সে উত্তরণের ব্রিজ স্কুলে ভর্তি হয়। বর্তমানে সে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। মাহিনুর লেখাপড়া করতে ভালোবাসে কিন্তু কাঁকড়ার পয়েন্টে কাজের চাপ থাকার কারণে স্কুলে সবসময় সম্পূর্ণ তিন ঘন্টা সময় দিতে পারেনা। মাহিনুর বলে, “ব্রিজ স্কুল আমার বাড়ির কাছাকাছি হওয়ার কারণে আমি লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছি। বাড়ি থেকে সরকারী স্কুল অনেক দুরে। সেখানে নিয়মিত যাওয়া সম্ভব নয়। আমি ব্রিজ স্কুল থেকে লেখাপড়া করে এস,এস,সি পাশ করতে চাই। উত্তরণ আমাকে চাকরির সুযোগ দিলে আমি চাকরি করব”। বুড়িগোয়ালিনীর সিবিসিপিসি সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘মাহিনুর খুবই দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছে। সিবিসিপিসি সদস্যদের পক্ষ থেকে তার দাদাকে সহায়তা করা হয়।’ তিনি বলেন, কাঁকড়ার পয়েন্টে কাজ করে মাহিনুর মাসে তিন হাজার টাকা আয় করে। তাকে জোর করে শ্রম থেকে মুক্ত করলে তার পরিবার খাবার পাবেনা, তাই আমরা তার পরিবারে আয়ের উৎস বৃদ্ধি করে তাকে শ্রমমুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সে যাতে লেখাপড়া থেকে সরে না যায় সে বিষয়েও আমরা সতর্ক রয়েছি। মাহিনুরের দাদা প্রতিবন্ধী রুহুল আমিন গাজী বলেন, ‘পিতামাতাহীন দু’টি সন্তানকে নিয়ে আমি খুব সমস্যার মধ্যে জীবনযাপন করছি। আমি তাদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছি। মাহিনুর যদি লেখাপড়া না করে তাহলে তার জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে। সে নিয়মিত ব্রিজ স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। তার স্বপ্ন বড় হয়ে অন্যান্য মানুষের মত চাকরি করবে। আমি তার স্বপ্ন পূরণের জন্য চেষ্টা করবো।’ উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমা আক্তার বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় বুড়িগোয়ালিনি, কাশিমাড়ী, গাবুরা ও মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে এডুকো প্রকল্পের বাস্তবায়নে চারটি ব্রিজ স্কুলে ৩৫০ জন শ্রমজীবী শিশুর শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই শিশুরা নিয়মিত ব্রিজ স্কুলে এসে লেখাপড়া করছে। এছাড়া ২০২৪ সালে ৫০ জন প্রশিক্ষাণার্থী ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সুইং মেশিন ও টেইলরিং, ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল ফোন সার্ভিসিং এবং ইলেকট্রিক হাউজ ওয়ারিং ও সোলার সিষ্টেম বিষয়ে তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ব্যবসাসহ আত্মকর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন কাজে যুক্ত রয়েছে। এরমধ্যে পিতৃহীন মাহিনুর রহমান বায়েজিদও অন্য ছেলে-মেয়েদের মতো সমানতালে পড়াশুনা শেষ করে চাকুরী করতে চায়। শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ এনামুল হক জানান, মূলত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত স্কুল বহির্ভূত শিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে আনার জন্যই এ ব্যবস্থা। এটি দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া উপকূলীয় এলাকায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button