কেশবপুরের ‘গ্রেট মাঙ্কি’ বলে খ্যাত কালো মুখো হনুমানের জীবনকাল এখন ঝুঁকিপূর্ণ

মোঃ আব্বাস উদ্দীন, মণিরামপুর থেকে ঃ খাদ্য, নিরাপত্তা ও অভয়ারণ্যের অভাব এবং পর্যাপ্ত বনাঞ্চল না থাকায় যশোরের কেশবপুর উপজেলার ‘গ্রেট মাঙ্কি’ বলে খ্যাত কালো মুখো হনুমানের জীবনকাল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে এসব হনুমান তাদের আবাসস্থল কেশবপুর উপজেলা ত্যাগ করে আশপাশের উপজেলা বিশেষ করে মণিরামপুর, অভয়নগর, যশোর সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। গত বুধবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুরে মণিরামপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসের গোলাপজাম গাছে এসে একটি হনুমান অবস্থান নেয়। এ সময় কলেজের উৎসুক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারীরা হনুমানটিকে দেখতে ভিড় জমান। একজন শিক্ষক হনুমানটিকে পাউরুটি খেতে দেন। কিন্তু হনুমানটি পাউরুটি না খেয়ে মন খারাপ করে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ সময় গাছটির নিচের ডালে বসে থাকে। এ সময় হনুমানটিকে বেশ ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল।
জানা যায়, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে কালো মুখো হনুমানের আবাসস্থলের প্রেক্ষিতে যশোরের কেশবপুর উপজেলা হনুমান পল্লী হিসেবে পরিচিত। দেশের অন্য কোথাও এই প্রজাতির হনুমান দেখা মেলে না। কেশবপুর শহর ও এর আশপাশে এখনো প্রায় ছয় শতাধিক কালো মুখো হনুমানের বসবাস রয়েছে। তবে পর্যাপ্ত খাবার ও অভয়ারণ্যের অভাবে কথিত শ্রীরামচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ অনুচর এককালের ‘গ্রেট মাঙ্কি’ বলে খ্যঠু বিরল প্রজাতির এই কালো মুখো হনুমান কালের বিবর্তনে এখন বিলুপ্তির পথে। খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, কেশবপুর উপজেলা শহরের পশু হাসপাতাল এলাকা, রামচন্দ্রপুর, বালিয়াডাঙ্গা, ব্রম্মকাটি,মধ্যকূল ও ভোগতী গ্রামে এদের বেশি বিচরণ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এসব হনুমান খাদ্যান্বেষণে তাদের দীর্ঘ সময়ের চিরচেনা আবাসভূমি কেশবপুর উপজেলা ত্যাগ করে আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে বেড়াচ্ছে। সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত খাদ্য প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মাঝে মাঝে বেসরকারি এনজিও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে খাদ্য সরবরাহ করা হলেও তা নিয়মিতভাবে করা হয় না । ফলে খাদ্যাভাবে বর্তমানে তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণহয়ে উঠেছে। তাছাড়া হনুমানের প্রজনন প্রিয়ডের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল না থাকায় এদের বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে তারা আবাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় বিচরণে মানুষ ও অন্য পশুপক্ষীর কাছে নির্যাতের শিকার হচ্ছে। আবার চাহিদা অনুযায়ী খাবার না পেয়ে তারা ক্রমেই হিং¯্র হয়ে উঠছে। কথা বলতে না পারলেও এ কালো মুখো হনুমানদের অনুভূতি শক্তি বেশ প্রকট। তাই কেশবপুরের মানুষের সঙ্গে রয়েছে এদের সখ্যতা। এরা মানুষের কাছ থেকে বাদাম, কলা, রুটি ইত্যাদি নিয়ে খায়। এছাড়াও এরা মানুষকে বিভিন্নভাবে বিনোদন দেয়। আবার কখনো কখনো মানুষের দ্বারা উত্ত্যক্ত হয়ে হিং¯্র হয়ে ওঠে। এ কালো মুখো হনুমান সাধারণত লম্বায় ২৪-৩০ ইঞ্চি এবং উচ্চতায় ১২-২০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এসব হনুমান ৫ বছর বয়স থেকে ৬ মাস অন্তর বাচ্চা প্রসব করে। এদের গড় আয়ু ২০-২৫ বছর। শারীরিক ওজন ৫-২৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। মুখের ন্যায় হাত ও পায়ের পাতা কালো। চলাফেরার সময় এরা লেজ উঁচু করে চলে। গাছের ডালে বসলে এরা আবার লেজটাকে ঝুঁলিয়ে দেয়। পেঁপে, আম, কলা, সফেদা, মূলা, আলু, বেগুন, শাকসবজি, কচিপাতা, বিস্কুট, বাদাম,পাউরুটি ইত্যাদি এদের প্রিয় খাবার।
বিরল প্রজাতির এই কালো মুখো হনুমানদের সরকারিভাবে ঠিকমতো দেখভাল না করা, এদের সংরক্ষণে তেমন কোনো উদ্যোগ না নেয়া, এদের প্রতি মানুষের অনিহার কারণে ও পর্যাপ্ত খাবার না থাকায় এরা আজ বিলুপ্তির পথে। এছাড়া, অভয়ারণ্যের অভাবে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসের কারণে কেশবপুরের হনুমানের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে ক্ষুধার তাড়নায় এসব হনুমান মানুষের ঘরে ঢোকে, দোকান থেকে কলা-রুটি নিয়ে খায়, সবজি খেত নষ্ট করে। আর এই কারণেই এদের প্রতি নির্মমভাবে নির্যাতন করে এক শ্রেণির নির্দয় কিছু মানুষ। মণিরামপুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও কেশবপুর উপজেলার মজিদপুর গ্রামের বাসিন্দা সহকারী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম খোকন জানান, কেশবপুর শহর ও শহরতলিতে প্রায় ছয় শতাধিক বিরল প্রজাতির কালো মুখো হনুমান রয়েছে। যা কেশবপুর এলাকার অতীত ঐতিহ্য ও ইতিহাসের একটা অংশ। দেশের অন্য কোথাও এদের দেখা মেলে না। উপযুক্ত আবাসস্থল ও খাদ্য এবং নিরাপত্তার অভাবে বিরল এই প্রজাতির প্রাণিটি এখন বিলুপ্তির পথে । এদেরকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে এগিয়ে আসা জরুরি। প্রয়োজনীয় খাদ্য ও নিরাপত্তা দিতে পারলে এসব বিরল প্রজাতির হনুমান তাদেও স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা ফিরে পাবে।