খুলনায় পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানে বছরে ব্যয় কোটি টাকা!

খুলনার সরকারি মাদক নিরাময় ও পুর্নবাসন কেন্দ্র
তিন বছর ধরে অচল
ল্যাব ও পরিবহন না থাকলেও রয়েছে টেকনোলজিস্ট ও ড্রাইভার
প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ গুণতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা
কামাল মোস্তফা : খুলনা বিভাগের একমাত্র সরকারি মাদক নিরাময় ও পুর্নবাসন কেন্দ্রটি অচল অবস্থায় আছে বিগত ৩ বছর যাবৎ। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডাক্তার না থাকায় রোগি ভর্তি বন্ধ। বিরানভূমির মতই পড়ে আছে হাসপাতালটি। হাসপাতালে ৪১ জনের জনবল থাকার কথা থাকলেও আছে ১৪ জন, যাদের কোন কাজ নেই। রোগি না থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আসেননা অফিসে। অচল প্রতিষ্ঠানটির পেছনে গেল তিন বছর ধরে সরকারকে গুণতে হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। সূত্র মতে, দেশে বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে অর্ধকোটির বেশি মানুষ মাদকাসক্ত থাকলেও তাদের চিকিৎসায় নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। বিশেষ করে সরকারি ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক। সারা দেশে মাত্র চারটি সরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ১৯৯টি শয্যায় চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১২৪টি শয্যা রয়েছে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। অন্যগুলোর শয্যা সংখ্যা ২৫টি করে। খুলনা বিভাগের ২৫ বেডের একমাত্র সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি গেল ৩ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। বন্ধের কারণ হিসেবে জানা যায়, মন্ত্রনালয় থেকে মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দেয়া হলেও তারা এখানে আসতে চাননা। আর ডাক্তার না থাকায় রোগি ভর্তি করা সম্ভব হয়না। ফলে কার্যত হাসপাতালটি বন্ধ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে বিনামূল্য মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেয়া হয়। একজন রোগির জন্য প্রতিদিন খাবার বাবদ ১৭৫ টাকা বরাদ্দ রয়েছে এখানে। বিনামূল্য ওষধ ছাড়াও সকল সেবাই ফ্রি।
২৫ শয্যার হাসপাতালটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা ৪১ জন, কিন্ত আছে ১৪ জন। ১৪ জনের মধ্যে রিহেবিলিটেশন অফিসার ১ জন, সাইকিয়টিক সোসাল ওয়ার্কার ১ জন, কাউন্সেলর ২ জন, সিনিয়র স্টাফ নার্স ৩ জন, ল্যাব সহকারি ১ জন, অফিস সহায়ক ১ জন, অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ১ জন, গাড়ি চালক ১ জন, সিপাই ১ জন, নিরাপত্তা প্রহরি ১ জন, ইলেকট্রিশিয়ান ১ জন। তবে কোন ধরণের ল্যাব সুবিধা ও পরিবহন ব্যবস্থা না থাকলেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে ল্যাব সহকারি ও ড্রাইভার। চলতি বছরের এপ্রিলে বিসিএস নন ক্যাডার থেকে নিয়োগ পেয়েছেন ১ জন রিহেবিলিটেশন অফিসার, ১ জন সাইকিয়টিক সোসাল ওয়ার্কার, ১ কাউন্সেলর। হাসপাতালটির ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে গুনতে হয় ৭৫ হাজার ৪০০ টাকা। বছরে প্রতিষ্ঠানটির ভাড়া বাবদ সরকারি বরাদ্দ ১০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিল বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ বছরে সরকারকে গুনতে হয় ২৬ লক্ষ টাকা হয়। তাদের চিকিৎসা ভাতা ২ লক্ষ টাকা, বাড়ি ভাড়া ভাতা ১৩ লক্ষ টাকা, এ ছাড়া যাতায়াত ব্যয়, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিছানা পত্র, চিকিৎসা ও শল্য, ওষধ ও প্রতিষেধক, কম্পিউটার মেরামত, খাদ্যদ্রব্যসহ নানান খাত বাবদ বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানটির পেছনে সরকার খরচ করছে ৭০ লক্ষ টাকা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গল্লামারী এলাকায় একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনের ৩য় ও ৫ম তলা ভাড়া নিয়ে হাসপাতালের অবস্থান। দুটি ফ্লোরের মধ্যে রোগিদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ টি রুম। বাকি রুমগুলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। রোগিদের ওয়ার্ডের খাটগুলো কোন রুমে এক উপর একটা জড়ো করে রাখা, কোন রুমে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। বেলা ১২ টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায় ১৪ জন কর্মচারীর মধ্যে উপস্থিত আছেন ৪ জন। গল্প করে সময় কাটাচ্ছেন। বাকিরা কখনো আসেন, কখনো আসেননা। নার্সের দায়িত্বে থাকা তিনজনের কেউ ছুটিতে কেউ মাঝে মধ্যে আসেন। এভাবেই চলছে প্রতিষ্ঠানটি। হাসপাতালটিতে কোন ল্যাব না থাকলেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে ল্যাব সহকারী, কোন পরিবহন না থাকলেও রয়েছে গাড়ীচালক। চলতি বছরের এপ্রিলে বিসিএস নন ক্যাডারের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন ১ জন রিহেবিলিটেশন অফিসার, ১ জন সাইকিয়টিক সোসাল ওয়ার্কার, ১ কাউন্সেলর।
কাউনন্সিলর সৌকত মন্ডল বলেন, আমি এখানে যোগদান করেছি ছয়মাস হলো। রোগি না থাকায় আমাদের তেমন কোন কাজ নেই। মূলত কোন রোগি ভর্তি হলে মেডিকেল অফিসার ঠিক করেন তিনি কোন কাউনন্সিলরের অধীনে চিকিৎসা নিবেন। ডাক্তার না থাকায় রোগি নেই, আর রোগি না থাকায় আমরাও অলস বসে থাকি। মাঝে মধ্যে আমাদের বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয়।
হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, ডাক্তারের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আমরা লিখিতভাবে কয়েকবার মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছি, কিন্তু ইতিবাচক সাড়া পাইনি। জেলার বিভিন্ন মিটিংয়ে হাসপাতালের অবস্থা তুলে ধরেছি। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন সহ সংশ্লিষ্ঠ সকলকেই অবহিত করা হয়েছে। অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে আইনি জটিলতা থাকায় ডাক্তার নিয়োগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তবে দ্রুই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
খুলনা জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ শেখ সফিকুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ডাক্তার নিয়োগের বিষয়ে আমাদের কাছে কোন নির্দেশনা আসেনি। এ ব্যাপারে কোন নির্দেশনা আসলে ব্যবস্থা নেবো।
খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটি’র (সনাক) সভাপতি এ্যাড. কুদরত-ই-খুদা বলেন, খুলনায় সরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রটি ডাক্তারের অভাবে বন্ধ থাকায় খুলনার মানুষ এই প্রতিষ্ঠানের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে এভাবে বসিয়ে বসিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোষার কোন যুক্তি নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানটি চালু করার দাবি জানাই।


