স্থানীয় সংবাদ

বিলুপ্তির পথে মণিরামপুরের তাঁত শিল্প! চরম দুর্দিনে তাঁতীরা!

মোঃ আব্বাস উদ্দীন, মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি ঃ চরম দুর্দিনে মণিরামপুরের তাঁতীরা! কাপড় তৈরীর মূলধনের অভাব, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, সরঞ্জামাদির দাম বৃদ্ধি, আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব তথা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম কুটির শিল্প “তাঁত শিল্প” আজ বিলুপ্তির পথে! এক সময়ে যশোরের মণিরামপুরের ঐতিহ্য ছিল তাঁত শিল্প। দিনরাত যখনই তাঁতপল্ল¬ীর পাশ দিয়ে মানুষ চলাফেরা করতেন তাঁতের ঠকর ঠকর শব্দে কান ধরে যেত তাদের। এখন অনেক গ্রামেই নেই তাঁত; নেই তাঁতের ঠকর ঠকর শব্দ। যা দুই একটি বাড়িতে তাঁত রয়েছে তার বেশির ভাগই এখন অকেজো। যেখানে সারাদিন বাহারী রঙ্গের গামছা, লুঙ্গী, শাড়ী তৈরীতে ব্যস্ত থাকতেন গ্রামের তাঁত শিল্পীরা। দিনের শেষে তাঁতের তৈরী গামছা, লুঙ্গী, শাড়ী বিক্রি করতে পশরা সাজিয়ে বিভিন্ন গ্রামের হাটে-গঞ্জে যেতো গ্রামের অধিকাংশ পুরুষেরা। এখানকার তৈরী কাপড় কিনতে বাইরের ব্যবসায়ীরাও আসতেন। এখন সেসব অতীত হতে চলেছে। মূলধনের অভাব, কাপড় তৈরীর প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, সরঞ্জামাদির দাম বৃদ্ধি, আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব,পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেকে এখন নেই বাপদাদার পেশায়। যোগ দিয়েছেন অন্য পেশায়। মণিরামপুর উপজেলার পাড়ালা, মুজগুন্নি, মনোহরপুর, শ্যামনগর, ভরতপুর, নেহালপুর, বালিধা, কাশিপুর, হাসাডাঙ্গা, হাজরাকাটি, মোহনপুর, কদমবাড়িয়া, জালালপুর, খড়িঞ্চি, খেদাপাড়া, আটঘরা, গৌঁরিপুর, চালুয়াহাটিসহ ৭৮টি গ্রামে প্রায় ৮০ হাজার তাঁতী পরিবারের মানুষদের বসবাস। এরমধ্যে পাড়ালা, মুজগুন্নি, মনোহরপুর, অটঘরা, গৈৗরিপুর, বালিধা, শ্যামনগর, ভরতপুর গ্রাম তাঁতবহুল এলাকা হিসেবে বেশী পরিচিত। এক সময় পাড়ালা গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙ্গতো তাঁতে কাপড় বুননের হ্যান্ডলুম ও পিটলুমের খটর-খটর শব্দে। বর্তমানে ওই পাড়ালা গ্রামে তাঁত যন্ত্রেও ঠক-ঠকি শব্দগুলো গুটিয়ে এসেছে। পাড়ালা গ্রামের প্রবীন তাঁতী আব্দুর রউফ (৮৬) একজন বড় তাঁত শিল্প পরিচালনা করতেন। এক সময় তাঁর বাড়িতে ৬৫টি হ্যান্ডলুম ও পিটলুম ছিল। এখন ২২টি তাঁত সচল আছে। মুজগুন্নি গ্রামের তাঁতী নজরুল ইসলামের এক সময় ৫০টি তাঁত ছিল ,আজ তা ১০টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ভরতপুর গ্রামের তাঁতী মহসিন আলীর বাড়িতে ৩৫টি তাঁত ছিল,আজ তা গুটিয়ে ৫টিতে এসে দাঁিড়য়েছে। তাঁত শ্রমিক নার্গিস বেগম বলেন, সারাদিন কাজ করে এক-দেড়শ টাকা পাই, তা দিয়ে পেটে ভাত হয়না, সংসার চলে না। প্রবীন তাঁতী আব্দুর রউফ বলেন, এ পেশায় এখন আর শ্রমিক পাওয়া যায় না। তাঁতে কাজ করে যা রোজগার হয় তার থেকে অধিক টাকা রোজগার করা যায় অন্য পেশায়। ফলে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না । তাছাড়া পুঁিজ-বাটা কম, রং ও সূতার দাম বেশী নানা কারণে তাঁতীরা এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। মুজগুন্নি গ্রামের তাঁতী নজরুল ইসলাম বলেন, এ কাজ করে সংসার চলে না, বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখিছি কোন রকমে। অনেকে যোগ দিয়েছে অন্য পেশায়। মাহমুদকাটি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী আকবর আলী বলেন, আমাদের পাশের গ্রাম কদমবাড়িয়া। এই গ্রামের তাঁতী পাড়ায় একশ’র বেশি পরিবার রয়েছে। যারা সবাই তাঁতের শাড়ি, গামছা ও লুঙি তৈরি করতেন। স্ত্রীর জন্য অনেকবার তাদের কাছ থেকে শাড়ি কিনেছি। এখন ওই গ্রামে কেউ তাঁত বুনেন না। সবাই এখন অন্য পেশায় চলে গেছেন। মণিরামপুর উপজেলা তাঁতী সমিতির নেতা মোঃ আব্দুল হাই বলেন, তাঁতী সম্প্রদায়কে অতীত পেশায় টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা। তা না হলে অচিরেই মণিরামপুর থেকে তাঁত শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যশোর মোমিননগর সমবায় শিল্প ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ লোকমান হোসেন বলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান করতে পারলে, সর্বোপরি তাঁতীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারলে তাঁদের অতীত গৌরবোজ্জল ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিশাত তামান্না বলেন,বাঙ্গালী সংস্কৃতি,ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক যত ঐতিহ্য আছে তার মধ্যে তাঁতশিল্প অন্যতম। তাঁত শিল্পের অতীত ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button