স্থানীয় সংবাদ

অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সংকটে খুমেক হাসপাতাল

# ধারণ ক্ষমতার তিনগুন রোগী ভর্তি
# শয্যা না পেয়ে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে রোগীরা

কে এইচ মনি ঃ খুলনা বিভাগে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান খুলনা মেডিকেল কলেজ ( খুমেক) হাসাপাতাল। কাগজ-কলমে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে খুলনাসহ বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে চিকিৎসা নিতে আসেন রোগীরা। ধারণ ক্ষমতার তিনগুন রোগী ভর্তি থাকে এ হাসপাতালে। বিশেষ করে তৃণমূলের গরীব ও অসহায় রোগীদের একমাত্র ভরাস্থল এ হাসপাতাল। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে ওষুধসহ নানা সংকটের কারণে চিকিৎসা নিতে এসে বিপাকে পড়তে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের।
গত কয়েক মাস ধরে গ্লোবস, সিরিঞ্জ, ক্যানোলা, সুতা ও ইউরিন ব্যাগ, এমনকি নরমাল স্যালাইনের সরবরাহ নেই এ হাসপাতালে। সম্প্রতি ফিল্মের অভাবে সীমিত আকারে করা হচ্ছে এমআরই ও সিটি স্ক্যান পরীক্ষা। ধীরে ধীরে ওষুধের এ সংকটে আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। বাধ্য হয়ে রোগীরা বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল থেকে চড়া মূল্যে এমআইআর ও সিটি স্ক্যান করাচ্ছেন রোগীরা।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাহিদার তুলনায় ওষুধ সরবরাহ কম থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ইতিমধ্যে হাসপাতালের ওষুধ ক্রয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে টে-ার আহবান করা হয়েছে। আমরা ইডিসিএল থেকে ওষুধ পাচ্ছি। এর বাইরেও ঠিকাদারের মাধ্যমে ওষুধ ক্রয় করে থাকি। তবে কোনো সেবা একেবারে বন্ধ হয়নি। শিগগিরই এ সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে।
গত রোববার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের সাথে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এমআই পরীক্ষার জন্য ফিল্ম মওজুদ রয়েছে ২০ দিনের মতো। আর এক্সরের জন্য ফিল্ম মওজুদ আছে ১ মাসে। গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা যা মওজুদ আছে তা রোগীর তুলনায় সরবরাহ কম। তাও এমাস পর্যন্ত চলতে পারে আবার নাও পারে। নরমাল ( এনএস) স্যালাইন মোটেও সরবরাহ নেই।
হাসপাতালের সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে খুমেক হাসপাতালের ওষুধের সরবরাহ তালিকা ছিলো ১২২ প্রকার ওষুধের। বর্তমানে ৫১ প্রকার ওষুধ রয়েছে তাও আবার চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এছাড়া সার্জিক্যাল আইটেম ছিলো ২৭ প্রকার। এখন মাত্র ৮ প্রকার সার্জিক্যাল আইটেম রয়েছে। এর মধ্যে গ্লোবস, সিরিঞ্জ, ক্যানোলা, সুতা ও ইউরিন ব্যাগ সরবরাহ নেই।
সংকটের কথা স্বীকার করে খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা: মোহাসিন আলী ফরাজী বলেন, সরকারি ঘোষণায় ৫০০ শয্যা হলেও জনবল আছে ২৫০ শয্যা হাসপাতালের। যদিও ওষুধ-পথ্য বরাদ্দ হচ্ছে ৫০০ রোগীর। অথচ ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল পর্যন্ত ভর্তি আছেন ১ হাজার ৪০২ জন। ২৫০ শয্যার জনবল দিয়ে দেড় হাজার রোগীর সেবা দেওয়া দু:সাধ্য হলেও সেই কাজটি করে চলেছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, ওটি সামগ্রী, এক্সরে, এমআরআই প্লেট সংকট আছে। জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের কারণে একটা স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল। দেরিতে হলেও সম্প্রতি টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। টেন্ডারের মালামাল সরবরাহ হলেই আগামী এক দেড় মাসের মধ্যে ওষুধও অপারেশন সামগ্রী, প্রয়োজনীয় ফ্লিম হাতে চলে আসবে।
খুমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, চাহিদার তুলনায় বর্তমানে হাসপাতালের ওষুধ সরবরাহ কম রয়েছে। ফিল্ম সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা গত কয়েকদিন হলো হাসপাতালের ওষুধ ক্রয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে দরপত্র আহবান করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলেই পরবর্তীতে ওই সংকটগুলো আর থাকবে না। তবে কোনো সেবা একেবারে বন্ধ হয়নি। আমরা সাধ্যমতে রোগীদের সেবা দেওয়া চেস্টা করছি।
সেতারা বেগম (৫৩) গত ২৯ জানুয়ারি মাঝায় ও ব্রেইনের সমস্যা নিয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। শয্যা সংকটের কারণে বেড না পেয়ে মেঝেতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার ছেলে রবিউল বলেন, মায়ের জন্য চিকিৎসকরা ১০ টা ইনজেকশন দিতে বলেছে। যার এক একটা দাম ৪৩০-৪৫০ টাকা। প্রথমদিন বাইরের ফার্মাসী থেকে জাপারিন নামক একটি ইনজেকশন দাম নিচ্ছে ৪৫০ টাকা। এরপরের দিন একই ইনজেকশন আরেক জায়গা থেকে কেনা লাগছে ৪৩০ টাকা। এমনকি ৫ টাকার দামের ইনজেকশনের একটি সিরিঞ্জ কেনা লাগছে। গতপরশু দুইটা ইনজেকশন হাসপাতাল থেকে আমাকে দিছে। আর বাকী ৮টি ইনজেকশন বাইরে থেকে কেনা লাগছে। সাথে আরও ওষুধ তো আছে। মায়ের এমআরআই করা লাগবে। হাসপাতালে এমআরআই পরীক্ষা করা গেলে তারা তিনদিন পর সিরিয়াল দিছে। পরে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে ৫ হাজার টাকায় এমআরআই করানো হয়েছে। তাদের মতো অনেকেই একই অভিযোগ করেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনরা।
একাধিক রোগী ও স্বজনরা জানান, ভর্তি হওয়ার পর প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ ওষুধই হাসপাতালের ডাক্তারদের দেওয়া স্লিপের মাধ্যমে বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনে নিচ্ছে। আর যাদের সামর্থ্য নেই তাদের বিনা চিকিৎসায় বাড়ি ফিরে যেতে হয়। বিশেষ করে কলেরা স্যালাইনের অভাবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ বাইরের ফার্মেসিগুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে না। আবার পাওয়া গেলেও দাম বেশি নিচ্ছে তারা।
হাসপাতালের আরএমও ডা: খান আহম্মেদ ইশতিয়াক বলেন, হাসপাতালের শয্যা সংখ্যার তুলনায় রোগীর ভর্তি তিনগুন। রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিলো প্রায় ১৪০০ কাছাকাছি। প্রতিদিন বহি: বিভাগে রোগী আসছে প্রায় ৭০০-৮০০ এর মতো। তিনি বলেন, এছাড়া প্রতিদিনই নতুন করে রোগী ভর্তি হচ্ছে। যার কারণে চাহিদার তুলনায় একটু ওষুধের ঘাটতি তো থাকবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button