স্থানীয় সংবাদ

কেসিসির নিয়োগ বাণিজ্যে শিকার চাকরি প্রত্যাশীরা

চাকুরি দেয়ার নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ
# অভিযোগ ওঠায় বড় বাবু নাঈমকে স্ট্যান্ড রিলিজ #

স্টাফ রিপোর্টার ঃ খুলনা সিটি করপোরেশনে নিয়োগ বাণিজ্যে শিকার চাকুরি প্রত্যাশীরা। চাকুরি দেয়ার নাম করে চাকুরি প্রত্যাশিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। অভিযোগ ওঠায় কেসিসির আলোচিত প্রশাসনিক শাখার বড় বাবু নাঈমকে বুধবার বিকেলে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। বুধবার কেসিসির সচিব শরীফ আসিফ রহমান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে তাকে অন্যত্র বদলী করা হয়। ওই অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়, “খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নি¤œমান সহকারী বর্তমানে প্রধান সহকারী হিসেবে কর্মরত মোঃ নাঈমুজ্জামানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে কেসিসি’র খালিশপুর “খ” অঞ্চলের কঞ্জারভেন্সি শাখায় নি¤œমান সহকারী পদে বদলি করা হলো এবং সাধারণ প্রশাসনিক শাখার নি¤œমান সহকারী জি.এম কুতুব উল আলমকে প্রশাসনিক শাখায় উচ্চমান সহকারী হিসেবে নির্দেশক্রমে চলতি দায়িত্ব প্রদান করা হলো। কর্পোরেশনের স্বার্থে এ আদেশ জারী করা হলো।” কেসিসির উচ্চমান সহকারী পদে চাকরির প্রলোভন দেওয়া হয় মো. শাহাদাৎ হোসেন নামের একজন চাকরি প্রত্যাশীকে। সেই প্রলোভনে পড়ে জমি বিক্রি ও ধার-দেনা করে করপোরেশনের প্রশাসনিক শাখার প্রধান সহকারী মো. নাঈমুজ্জামান ওরফে নাঈমের কাছে ১৭ লাখ টাকা তুলে দেন শাহাদাৎ। অথচ সে চাকরিও পাননি; ফেরত পাচ্ছেন না টাকাও। শুধুই মো. শাহাদাৎ হোসেন নয়; অভিযোগ উঠেছে করপোরেশনে চাকরি দেওয়া প্রলোভনে দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে সাড়ে ৩ লাখ, ৪ লাখ, ৫ লাখ, ১৭ লাখ ও ২৭ লাখ টাকা করে ১০ থেকে ১২ জন চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে কমপক্ষে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মো. নাঈমুজ্জামান। তার খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব ভুক্তভোগীদের পরিবার। তবে অস্থায়ী পদে কম ও স্থায়ী পদের জন্য বেশি অর্থ গ্রহণ করেছেন তিনি। তবে তিনি একা নয় এই নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে আরো রাঘব বোয়ালরা জড়িত রয়েছে বলে সূত্রটি জানায়। এ বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর চক্রটির দৌড়ঝাপ শুরু করে। অভিযোগকারী ও স্বাক্ষীদের ম্যানেজ করতে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর ২৫টি শূন্য পদে জনবল চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিটি করপোরেশন। এরপর ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর করপোরেশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ১৭টি শূন্য পদ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণের জন্য দরখাস্তের আহ্বান করা হয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ৪ অক্টোবর করপোরেশনে বাজেট বরাদ্দ সাপেক্ষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজে শর্ত সাপেক্ষ ৩০০ জন শ্রমিক নিয়োজিত করতে প্রশাসনিক অনুমোদন মেলে। সেই অনুমোদন সাপেক্ষ চাহিদার আলোকে নানা সময়ে বহিরাগত জনবল নিয়োগ চলমান রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ৫ আগস্টের পর সাবেক মেয়র তালুকদার আঃ খালেকের নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করায় বিপদে পড়ে নিয়োগ বাণিজ্যচক্রের সাথে জড়িতরা। ওই চক্রটি চাকুরি প্রত্যাশিদের দিয়ে শেষ পর্যন্ত কেসিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন পর্যন্ত করায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অনড় থাকায় তারা পিছু হটে। তবে চাকুরি জন্য টাকা ফেরৎ চাওয়া নিয়ে এ চক্রের সাথে মত বিরোধ সৃষ্টি হয়। তারই জের ধরে চাকুরি প্রত্যাশিরা উকিল নোটিশ, জিডি, মামলা করেন। প্রতারণায় শিকার সিরাজুল বলেন, নাঈমের কাছে চাকুরির জন্য দেয়া টাকা ফেরৎ চাইতে গেলে তিনি একের পর এক কালক্ষেপন করতে থাকেন। পরে তিনি হাত পা ভাঙ্গার হুমকি দেন। পরে এ ঘটনায় খুলনা সদর জিডি করা হয়। একই সাথে তাকে উকিল নোটিশ দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কর্পোরেশনের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত জনবল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিকে পুঁজি করে সংশ্লিষ্ট অফিসের প্রশাসনিক শাখার প্রধান সহকারী মো. নাঈমুজ্জামান চাকরি বাণিজ্যে নামেন। তার সাথে ৭/৮ জনের একটি চক্র রয়েছে। চাকরি প্রত্যাশীদের প্রলোভন ফেলে তার কয়েকটি ব্যাংকের নিজের নামের অ্যাকাউন্টের চেক দিয়ে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের অর্থ। কিন্তু টাকা দেওয়ার পর চাকরি প্রত্যাশীরা তার মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন। কারণ পরে তারা চাকরিও পাচ্ছেন না, ফেরত পাচ্ছেন না টাকাও। অনেক ভুক্তভোগী বাধ্য হয়ে আদালতে মামলাও করেছেন। তবে মামলা ও চেক ডিজ-অনার করে তার হুমকিরও সম্মুখীন হয়েছেন অনেকে। মো. নাঈমুজ্জামানের নিজের অ্যাকাউন্ট ও নামীয় দেওয়া এমন তিনটি চেক পাওয়া গেছে। চেকগুলোর মাধ্যমে মো. শাহাদাৎ হোসেনকে দু’ দফায় ৫ লাখ ও ১২ লাখ এবং মো. সিরাজুল ইসলামকে ৪ লাখ টাকা দেওয়া সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে নাঈম বলেছেন, চাকুরির জন্য শাহাদাৎ ও সিরাজের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নেয়া হয়। তবে দু’দফা চেক দেয়া হয়। পূর্বের চেক ফেরৎ না নেয়ার টাকা পরিমাণ বেশী বলছে। ভুক্তভোগী করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরের সিএ টু প্রণিক মো. মিজানুর রহমান জানান, আমার এক আত্মীয়কে চাকরি দেবে এমন প্রতিশ্রুতিতে সাড়ে ৩ লাখ টাকা গ্রহণ করে মো. নাঈমুজ্জামান। অথচ চাকরি দিতে পারেনি। তার কাছে অনেক বার টাকা চেয়েও ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। আরেক ভুক্তভোগী কেসিসির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ভারতী ঢালী বলেন, তার চাকরির পেনশনের টাকা ছেলের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার পদে স্থায়ী চাকরির জন্য মো. নাঈমুজ্জামানের কাছে তুলে দেন। অথচ সেই চাকরি হয়নি। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সেই টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। তবে নাঈম বলেন, ভারতীর কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা নেয়া হয়। কর্তৃপক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ায় তাদের টাকা ফেরৎ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কেসিসি কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি উজ্জ্বল কুমার সাহা বলেন, দু’টি চেকে দিয়ে ভারতী ঢালীর ছেলেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২৭ লাখ টাকা নিয়েছে মো. নাঈমুজ্জামান। ভারতী চেক ডিজ-অনার করে আদালতে মামলা করেছে। শুধুই ভারতী না; এমন অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আরও বলেন, মো. নাঈমুজ্জামান করপোরেশনের প্রশাসনিক শাখায় কর্মরত রয়েছে। এছাড়া করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিবের সঙ্গে তার চাকরি দেওয়া ব্যাপারে কথা হয়েছে এমন বানোয়াট কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। মুখের ওসব কথা শুনে সাধারণ মানুষও সরল বিশ^াসে টাকা দিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। এ কারণে করপোশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে মো. নাঈমুজ্জামান বলেন, টাকাগুলো তার মাধ্যম এসেছে। কিন্তু প্রথম চেক দেয়ার পর আবারো চেক দেয়া হয়। কিন্তু পূর্বের চেক ফেরৎ না নেয়ার কারণে টাকার পরিমাণ বেশী দেখাচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। কেসিসির সচিব শরীফ আসিফ রহমান বলেন, নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠায় তাকে অন্যত্র বদলী করা হয়েছে। একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিম গঠন করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারণ নিয়োগ বাণিজ্যচক্রটি স্নাক্ত করা খুবই জরুরী বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button