জাতীয় সংবাদ

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৩ স্কুলের ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই কোচিং করে

সম্প্রতি খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলা এবং বাগেরহাট জেলার মোংলা ও মোড়লগঞ্জ উপজেলার ২৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮০৪ জন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের উপর চালানো এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে

প্রবাহ রিপোর্ট : দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুটি জেলার চারটি উপজেলার ২৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ উদ্যোগে বা স্কুলে কোচিং করে। এর মধ্যে ৫৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ উদ্যোগে কোচিং করে, ২৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুল শিক্ষকের কাছে কোচিং করে এবং ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে কোচিং করে। এছাড়া ১ দশমিক ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে প্রদত্ত গাইড বই ব্যবহার করে। সম্প্রতি খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলা এবং বাগেরহাট জেলার মোংলা ও মোড়লগঞ্জ উপজেলার ২৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮০৪ জন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের উপর চালানো এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে। দেশের দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষায় পাঠদান, শিখন এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ঘাটতি নিয়ে এই গবেষণা চালায় ওয়েব ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। গতকাল রোববার রাজধানীর তোপখানা রোডে অবস্থিত সিরডাপ মিলনায়তনের এ টি এম শামসুল হক মিলনায়তনে এই গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি ‘শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে জাতীয় নীতি সংলাপে’রও আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে গবেষণার আলোকে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রধান গবেষক শাহজাদা এম আকরম। তিনি বলেন, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮০৪ জনের মধ্যে ৫০ শতাংশ অভিভাবক ও ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল মেয়ে শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের গড় বয়স ১০ বছর এবং অভিভাবকদের গড় বয়স ৩৬ বছর। শিক্ষার্থীদের ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ তৃতীয় শ্রেণীতে, ৩৬ দশমিক ৮২ শতাংশ চতুর্থ শ্রণীতে এবং ৪১ দশমিক ২৯ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশুনা করছে। তিনি আরো জানান, যেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জরিপ চালানো হয়েছে, তার সবগুলোই সাইক্লোন সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব বিদ্যালয়ের গড় শিক্ষার্থী ১১৬ দশমিক ৫৭ জন। গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে তিনি বলেন, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত বিদ্যালয়গুলোতে শিখন-শেখানোর পদ্ধতি এখনো মূলত শিক্ষক কেন্দ্রিক। এসব বিদ্যালয়ে অধিকাংশেই পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। শিক্ষকরা প্রায়ই প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। প্রায় সব ছাত্রই নিয়মিত বিদ্যালয়ে যায়; সব শিক্ষক বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকেন এবং শ্রেণীকক্ষে পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ (বোর্ড, ডাস্টার, চক, নোটবুক, বই) আছে। শিক্ষার্থীরা স্কুলের বাইরে শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রাইভেট এবং ব্যক্তিগত কোচিং নেয়। অর্ধেকেরও বেশি ছাত্র নিজ উদ্যোগে কোচিং নেয়; প্রায় এক চতুর্থাংশ স্কুল শিক্ষকতের কাছ থেকে কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনি নেয়। কয়েকটি স্কুল থেকে গাইড বই সরবরাহ করা হয়, যদিও শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, গাইড বই সরবরাহ করা হয় না। জরিপ চালানো এসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের কোচিং করার হার তুলে ধরে শাহজাদা এম আকরাম বলেন, টিউশন এবং গাইড বইয়ের জন্য অভিভাবকদের প্রতি মাসে ২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। এর মধ্যে নিজ উদ্যোগে কোচিংয়ের জন্য গড়ে প্রতিমাসে ৮৩৪ টাকা, স্কুল শিক্ষকের কাছে কোচিংয়ের জন্য গড়ে প্রতি মাসে ৫২১ টাকা এবং স্কুলে কোচিংয়ের জন্য প্রতি মাসে গড়ে ৩৬৭ টাকা ব্যয় করতে হয় অভিভাবকদের। এ সময় তিনি দুর্যোগপ্রবণ এলকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান উন্নয়নে বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন। সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে ওয়েব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বলেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা চিন্তা করলে প্রথমেই আসে শিক্ষা। শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে, তবে গুণগত শিক্ষায় আমরা এখনও পিছিয়ে আছি এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়। ওয়েভ ফাউন্ডেশন এডুকেশন আউটলাউড প্রকল্পের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে গবেষণায় সম্পৃক্ত হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ ৭টি পক্ষ রয়েছে। এই পক্ষগুলোর সমন্বয়ের দুর্বলতা গুণগত মান অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গুণগত মান অর্জনে পিছিয়ে থাকায় আমরা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও যোগ্য মানুষকে সবসময় খুঁজে পাই না। দূর্যোগপ্রবণ এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকদেরকে দুর্যোগকালে ও পরবর্তীতে শিক্ষার ক্ষেত্রেও কাজে লাগাতে হবে। সংলাপে অন্যান্য বক্তারা বলেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে দরকার যথাযথ পরিকল্পনা, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, প্রয়োজনীয় বাজেট ও অবকাঠামো বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক স্বল্পতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, দুর্যোগকালে ও পরবর্তীতে করণীয় সম্পর্কে প্রস্তুতির অভাব, তদারকির অভাব প্রভৃতি সমস্যা রয়েছে। সেজন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নতুন শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষক প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব প্রদান, বিদ্যালয় অবকাঠামোর সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, দুর্যোগ-ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পর্যায়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ওয়েব ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমার সঞ্চালণায় সংলাপে আরো উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (কার্যক্রম) ও যুগ্মসচিব মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রঞ্জন সাহা পার্থ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ফেলো সিবান শাহানা এবং স্ট্রিট চাইল্ড ইউকে’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইমতিয়াজ হৃদয়।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button