জাতীয় সংবাদ

সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধোঁয়া তুলে ছাত্র জানতার ৫ই আগস্টের বিজয় নস্যাতে চলছে গভীর ষড়যন্ত্র

* বিগত আওয়ামী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র সরকারি পর্যায়ের চাকরি, পোস্টিং ও পদোন্নতিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় তা বহাল রাখতে এবং ভবিষ্যতেও যাতে তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে সেজন্য এই বিষয়টি থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানোর জন্যই মূলত সংখ্যালঘু নির্যাতনের এই ভুয়া ইস্যু তৈরি করা হয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞর অভিমত।
*হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুরের খবর ভুয়া : বি.বি.সি
*বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর হামলা নিয়ে ভারত মিথ্যা প্রপাগেন্ডা চালাচ্ছে : আল জাজিরা
*পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর হামলার খবর যে মিথ্যা তা অবহিত করা হচ্ছে।
* বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে ভুয়া তথ্যে কান দিবেন না : মমতা ব্যানার্জী
*হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির পুড়ানোর অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা প্রচারণার নেপথ্যে রয়েছে নীল নকশা। সংখ্যালঘু নির্যাতন নাটক রচনার পিছনে ভারতীয় সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
*মন্দির পাহারায় মুসলিমদের ভূমিকা প্রচারণায় নেই।

প্রবাহ রিপোর্ট ঃ শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর জুডিশিয়াল ক্যু’র অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এবার ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ ইস্যু নিয়ে মাঠে নেমেছে একটি গোষ্ঠী। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ‘বাংলাদেশে সংঘ্যালঘু নির্যাতনে’র কথা প্রচার করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে তারা। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে ফুলিয়ে ফাপিয়ে চলছে অপপ্রচার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। কিন্তু খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-প্রতিষ্ঠান পাহারায় মুসলিমদের ভূমিকার কোন প্রচারণা চালানো হচ্ছে না। এভাবে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া দেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করার নীল নকশা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের মিথ্যা তথ্য পুঁজি করে বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ-বিক্ষোভ হচ্ছে। অন্যদিকে এদেশীয় কিছু তাবেদার গণমাধ্যম হিন্দু নির্যাতনের গালগল্প ফলাও করে প্রচার করছে।
কিন্তু সাধারণ হিন্দুধর্মীদের অনেক বিবেকবান মানুষ বলছেন, বর্তমান সরকার ও জনগণ হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সূত্র জানায়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার অভিযোগ এনে বুধবার (৭ আগস্ট) দুপুরে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবনে ওয়ার্ল্ড হিন্দু স্ট্রাগল কমিটির সভাপতি শিপন কুমার বসু’র প্রেসক্রিপশনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন আল আমিন শেখ জনি নামে খুলনার এক বাসিন্দা। কিন্তু, কোনো তথ্যই তিনি দিতে পারেননি। তিনি নিজেকে সংগঠনের পাবলিসিটি সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে দাবি করেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরপরই খুলনার বিভিন্ন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হামলা হচ্ছে। এ সময় সাংবাদিকরা তার কাছে জেলার কোথায়, কোন মন্দির, বাসা-বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে জানতে চাইলে জনি কোনো তথ্য দিতে পারেননি। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিতে আসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনার রূপসা উপজেলার অন্যতম সহ-সমন্বয়ক দাবিদার মোহাম্মদ নাঈম। তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। পরে সাংবাদিকরা হামলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে উত্তরে নাঈম বলেন, আমি কিছু জানি না। আমরা ছাত্রদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু কলেজ এলাকায় রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করছিলাম। আমাকে ফোন করে ডেকে আনা হয়েছে। এরপর তিনি সব সাংবাদিকের কাছে ক্ষমা চেয়ে সম্মেলন থেকে বিদায় নেন। পরে জনিকে সাংবাদিকরা সংগঠনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, ওয়ার্ল্ড হিন্দু স্ট্রাগল কমিটির সভাপতি শিপন কুমার বসু। তিনি দিল্লিতে থাকেন। অপরদিকে, শনিবার (১০ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘সারা দেশে হামলা, দোকানপাট ও বাড়িঘর লুট, মঠ-মন্দিরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ বন্ধে রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সনাতন পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অনুপ কুমার দত্ত বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার জন্য একটি গোষ্ঠী সংখ্যালঘু নির্যাতনের ফানুস উড়াচ্ছে। অনতিবিলম্বে তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দিরে হামলা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণার রহস্য উন্মোচন করল বিবিসি : শেখ হাসিনা ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে যে সহিংসতা চলেছিল, তার মধ্যেই এমন বহু ভুয়া পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দাবি করা হয় বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ব্যাপক অত্যাচার শুরু হয়েছে। তবে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে ‘ব্যাপক অত্যাচার’ হচ্ছে বলে যেসব ভুয়া পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার বেশিরভাগই ভারতীয় বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল বলে ফ্যাক্ট-চেকাররা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকেও এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে, এমনটাও ফ্যাক্ট-চেকাররা বলছেন। তারা এটাও বলছেন যে, নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে কিছু আক্রমণ হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে, মুসলমানদের বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে, জ্বালানো হয়েছে। এক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, সম্পত্তি। ধর্মীয় পরিচয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৌণ ছিল, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্যই তারা আক্রান্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের যেসব স্থানীয় নেতা-কর্মী পালিয়ে ভারতে চলে এসেছেন অথবা আসার চেষ্টা করছেন, তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে হিন্দু আর মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িতেই হামলা হয়েছে। কিন্তু ভারত থেকে সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট- বিষয়টিকে রাজনৈতিক না রেখে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন একাধিক ফ্যাক্ট চেকার। বিবিসির তথ্য যাচাইয়ের বিভাগ, ‘বিবিসি ভেরিফাই’-ও একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।
মন্দির পাহারায় মইনুল ঃ হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ হয়েছে বলে যে ধরনের পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল, তার কয়েকটি চোখে পড়েছিল চট্টগ্রামের এক বিক্ষোভকারী মইনুলের। বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ ‘বিবিসি ভেরিফাই’ যখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তিনি সেসময়ে চট্টগ্রাম লাগোয়া ‘শ্রী শ্রী সীতা কালী মাতা মন্দির’ পাহারা দিচ্ছিলেন। তার বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। মইনুল বলেন, ‘তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব তো আমাদের। আমরা সব সরকারি স্থাপনা, মন্দির, গির্জা সব কিছুই রক্ষা করব।’ তার কথায়, যেসব পোস্ট ছড়াচ্ছে, সেগুলো কিন্তু ‘আমাদের চোখে দেখা বাস্তব ছবির সঙ্গে মিলছে না। ওই সব পোস্ট বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটা ভুল ছবি তুলে ধরছে।’ বিক্ষোভকারীদের ওপরে ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যা শেষে যখন শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বিক্ষোভকারী ও বিরোধী দলীয় সদস্যদের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা খুব আশ্চর্যের কিছু ছিল না।
ভারত থেকে ছড়ানো হয় ভুয়া খবর: চারদিকে যখন একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছিল, সেই সময়ে ভারতের অতি-দক্ষিণ-পন্থি ‘ইনফ্লুয়েন্সর’রা সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভ্রান্তিকর ভিডিও শেয়ার করতে থাকেন, যাতে মনে হয় যে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার হচ্ছে। এ ছাড়া এরকম গুজবও ছড়ানো হয় যে ছাত্র-বিক্ষোভকারীরা ‘ইসলামি কট্টরপন্থি’। সামাজিক মাধ্যমের ওপরে নজর রাখে ‘ব্র্যান্ডওয়াচ’ অ্যাপ। তারা খুঁজে পেয়েছে যে, ৪ আগস্টের পর থেকে ভুয়া কাহিনীগুলি ছড়ানো হয়েছে এমন একটি হ্যাশট্যাগ দিয়ে, যেটি সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) সাত লক্ষ বার মেনশন হয়েছে। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে ট্রেন্ডিং পোস্টগুলি করা হয়েছিল, তার প্রায় সবই ভারতে অবস্থান করছে, এমনটাও জানা গেছে ‘ব্র্যা-ওয়াচ’ থেকে।
বাংলাদেশ-ভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকাররাও গত কদিনের সামাজিক মাধ্যম বিশ্লেষণ করে অনেকটা একইরকম তথ্য পেয়েছেন যে, মূলত ভারতের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকেই হিন্দুদের ওপরে আক্রমণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ বা ইউল্যাবের অনুমোদনপ্রাপ্ত স্বাধীন তথ্য যাচাই করার উদ্যোগ ‘ফ্যাক্ট ওয়াচ’এর প্রধান, অধ্যাপক সুমন রহমান বলছিলেন, ‘কিছু ঘটনা ঘটেছে ঠিকই, যেখানে হিন্দুদের বাড়ি আক্রমণ করা হয়েছে। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওই ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি।’ ‘কিন্তু এমন একটা আখ্যান তৈরি করা হয়েছে, যাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে। এটা একেবারেই ভুল আখ্যান ছড়ানো হয়েছে। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে এই ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে, সেগুলির বেশিরভাগই ভারতের,’ বলেন তিনি। আবার ঢাকার ফ্যাক্ট চেকার রিদওয়ানুল ইসলাম বলছিলেন, ভারতীয় অ্যাকাউন্টগুলি থেকেই বেশিরভাগ ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে। ‘তবে বাংলাদেশের ভেতর থেকেও হিন্দুদের ওপরে আক্রমণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে বলে আমাদের অনুসন্ধানে জানতে পারছি।’
হিন্দুদের বাড়ি, মন্দির ‘জ্বালানো’র ভুয়া খবর: সামাজিক মাধ্যমে একটা পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল, যাতে দাবি করা হয়েছিল যে ‘হিন্দু ক্রিকেটার’ লিটন দাসের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য অনেক অ্যাকাউন্ট থেকে সেই পোস্ট শেয়ার করে লেখা হয় যে, কট্টর ইসলামপন্থিরা তার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যে বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছিল, সেটা যে আসলে বাংলাদেশের জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার, তা এখন সবার জানা। আরেকটি ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা হয়েছিল যে, ‘বাংলাদেশের ইসলামি জনতা’ একটা মন্দিরে আক্রমণ করেছে। চট্টগ্রামের ‘নবগ্রহ মন্দির’এর কাছে আগুন লাগানোর ভিডিও ছড়ানো হয়েছিল। তবে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে মন্দিরে আগুন লাগেনি। বিবিসি ভেরিফাইয়ের কাছে ছবি এসেছে যে, ওই মন্দিরের কোনও ক্ষতি হয়নি। তবে ওই মন্দিরের পিছনে আওয়ামী লীগের একটি কার্যালয়ই আসল লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয়েছে। মন্দিরের কর্মকর্তা স্বপন দাস বিবিসিকে জানিয়েছেন, ওই দলীয় কার্যালয় থেকে চেয়ার- টেবিল বার করে আগুন লাগানো হয়েছিল মন্দিরটির পিছন দিকে। এ ঘটনা ৫ আগস্ট দুপুরের। অগ্নিকা-ের পরের কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে যে, আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবিসহ বেশ কিছু পোস্টারও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি আরও জানিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টাই মন্দিরে পাহারা দিচ্ছেন মানুষ।
লক্ষ্য আওয়ামী লীগ, হিন্দুরা নয়: আরও দুটি ভাইরাল হওয়া পোস্টে দেখা গেছে যে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে দাবি করা হয়েছে যে হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু যাচাই করে দেখা গেছে যাদের ওপরে আক্রমণ করা হয়েছিল, তারা আসলে আওয়ামী লীগের নেতা এবং তারা মুসলমান। এইসব পোস্টই ভারতীয় দক্ষিণ-পন্থি অ্যাকাউন্টগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ‘সেভবাংলাদেশীহিন্দু’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে সেসব শেয়ার করা হয় হিন্দুত্ববাদীদের ‘ভেরিফায়েড’ অ্যাকাউন্ট থেকে। সম্প্রতি আরও একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে ‘ইসলামি জনতা’ হিন্দুদের গ্রাম আক্রমণ করেছে এবং একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুকুরে সাঁতার কেটে পালানোর চেষ্টা করছে। ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকাররাই খুঁজে বার করেছেন যে ওই ব্যক্তি মুসলমান।
ইউল্যাবের ‘ফ্যাক্ট-ওয়াচ’এর প্রধান, অধ্যাপক সুমন রহমান বলছিলেন, ‘সম্প্রতি দুই নারীকে কিডন্যাপের কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। এর মধ্যে একটি ঘটনা ঢাকার, অন্যটি নোয়াখালীর। ঢাকার ঘটনাটি হলো- একটি ছাত্রী রাস্তায় ট্র্যাফিক ডিউটি করছিল দীর্ঘক্ষণ। তার বাবা মা-ই জোরপূর্বক তাকে বাড়ি নিয়ে যান।’
অধ্যাপক রহমান বলেন, সেই ভিডিওকে বলা হলো যে, ওই ছাত্রীকে নাকি কিডন্যাপ করা হয়েছে। আর নোয়াখালীর ঘটনায় যে নারীকে কয়েকজন ‘গণধর্ষণ’-এর জন্য কিডন্যাপ করা হয়েছে বলা হচ্ছে, আসল ঘটনা হলো ওই হিন্দু নারী প্রাক্তন স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে নিজের বাবা-মায়ের কাছে থাকছিলেন। কিন্তু তার স্বামী কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ওই নারীকে উঠিয়ে নিয়ে যান। এটাকে ‘হিন্দু নারীকে গণধর্ষণের জন্য কিডন্যাপ’ বলে চালানো হয়েছে।
ফ্যাক্ট-চেকার রিদওয়ানুল ইসলামের কথায়, ‘শুধু যে সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়েছে, তা নয়। কয়েকটি টিভি চ্যানেল এবং পোর্টালও সামাজিক মাধ্যমের ওই সব গুজবের ওপরে ভিত্তি করে সংবাদ প্রতিবেদন পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে।’
এদিকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে সংখ্যালঘু ইস্যু সৃষ্টি করতে আওয়ামী সন্ত্রাসীরাই হিন্দু ভাইদের বাড়ীতে অতর্কিত হামলা চালাচ্ছে- অভিযোগ করে খুলনা জেলা বিএনপি’র আহবায়ক আমীর এজাজ খান বলেছেন, টানা সাড়ে ১৫ বছর অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ছাত্র-জনতা অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পরাজিত আওয়ামী সন্ত্রাসীরা মরণকামড় দিচ্ছে। বিএনপি ধ্বংসজ্ঞের রাজনীতি করে না। সকল সম্প্রদায়ের মিলিত শক্তি দেশ গড়ার হাতিয়ার। সন্ত্রাসীরা যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ী, মন্দির ও তাদের ধন-সম্পদের স্পর্শ করতে না পারে বিএনপি’র সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা পাড়া-মহল্লায় পাহারা দিচ্ছেন। সোমবার (০৫ আগস্ট) বটিয়াঘাটার চক্রাখালী এলাকায় অরবিন্দ মহলদারের বাড়ী পরিদর্শনকালে তিনি এসব কথা বলেন। চিহিৃত সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অপর এক বিবৃতিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সজাগ সৃষ্টি রাখতে অতন্ত্র প্রহরীর ভূমিকা পালনের আহবান জানিয়েছে খুলনা বিএনপি।
অপরদিকে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিপন্নকরণে ভারতের মদদ রয়েছে দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম। রবিবার (১১ আগস্ট) সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ দাবি করেছে সংগঠনটি। বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে সবসময় সংখ্যালঘু নির্যাতনের বেনিফিশিয়ারি হয়েছে ভারত ও স্বৈরাচার হাসিনা। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতের কিছু মুসলিমবিদ্বেষী মিডিয়া ও রাজনীতিক বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা শুরু করেছে। সেটার প্রভাব হিসেবে এদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। এসবের নেপথ্যে ভারতের ইন্ধন রয়েছে বলে আমরা মনে করি।’ তারা আরো বলেন, ‘পলাতক শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত আবারো প্রমাণ করেছে তারা হাসিনার মতো একজন ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারকে দেড় দশক বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল। ভারতের এমন বিতর্কিত ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলে এবং ভারত-বয়কটের প্রচারণা বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
তারা বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের জানমাল ও উপাসনালয় রক্ষায় প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় ছাত্র-জনতা দ্রুত এগিয়ে আসায় ভারতের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে গেছে। আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা আমরা আপামর জনগণই নিশ্চিত করছি। এক্ষেত্রে ভারতের নাক গলানো এবং বাংলাদেশকে অস্থির করে তুলতে ভারতীয় ইন্ধনের তীব্র নিন্দা জানান তারা।
বিবিসি বাংলা প্রতিবেদন : বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ বিবিসি ভেরিফাই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টের অনেকগুলো যাচাই করে দেখেছে, যাতে দেখা গেছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি অনেক হামলার গুজবও ছড়ানো হয়েছে।
এর মধ্যে, শনিবার বাংলাদেশে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ নামে দুইটি সংগঠন দাবি করেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের ৫২টি জেলায় সংখ্যালঘু মানুষের ওপর ২০৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
তবে এই সব কয়টি ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হামলা হয়েছে, নাকি সরকার ঘনিষ্ঠদের ওপর ক্ষোভের অংশ হিসেবে হামলা হযেছে, তা নিরপেক্ষ ভাবে যাচাই সম্ভব হয়নি।
এদিকে, বাংলাদেশ হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু এবং সেদেশে বসবাসকারী বারতীয়দের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে একটি বিশেষ কমিটি গড়েছে ভারত সরকার।
আর বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠার পর দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় রবিবার থেকে হটলাইন চালু করতে চাইছে সে দেশের সরকার।
আল-জাজিরা প্রতিবেদন : বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে কিছু অপতথ্য ও ভুয়া ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই ভুয়া ভিডিও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হচ্চে। যেমন চট্টগ্রামের নবগ্রহ মন্দিরে হামলার ঘটনা দাবি করে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয় ডেইলি লেটেস্ট আপডেটস নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে যেখানে #অষষ ঊুবং ঙহ ইধহমষধফবংযর ঐরহফঁং এবং #ঝধাব ইধহমষধফবংযর ঐরহফঁং হ্যাশট্যাগ ছিল। ভিডিওটি ভারতীয় গণমাধ্যম রিপাবলিক টিভির অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলেও প্রচার করা হয়।
অনলাইন যাচাই ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিস ল্যাব বলছে, নবগ্রহ মন্দিরে অগ্নিসংযোগ বা আগুন দেওয়ার বিষযটি টিক নয়। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই ভিডিওতে অপপ্রচার বলে দাবি করেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, চট্টগ্রামের লালদীঘি পাড়াসংলগ্ন নবগ্রহ মন্দিরে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। হামলা হয়েছে মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থিত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে। সেখানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ওই ব্যক্ত অক্ষত মন্দিরের ছবি পাঠিয়ে জানান, মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক স্বপন দাসও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিক্ েকেটি সংবাদ মাধ্যম যোগাযোগ করে জেনেছে, অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি নবগ্রহ মন্দিরের নয়। মন্দিরটির পরিচালনা কমিটির উপদেষ্টা রনি বিশ্বাস সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘মন্দিরে আমরা সার্বক্ষনিক পাহারা দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত কিছু হয়নি। তিনিও জানান যে আগুনের ঘটনাটি মন্দিরের পেছনে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button