লস অ্যাঞ্জেলসে দাবানল : ভষ্মিভূত হলিউড হিলস

# ‘আমি কোথায় যাবো দাবানল থেকে বাঁচতে হলিউডে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকা মানুষের আর্তি #
# ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কাজ করছেন সাত হাজারের বেশি ফায়ার ফাইটার #
প্রবাহ রিপোর্ট ঃ ইতিহাসের সেরা চলচ্চিত্র স্পট হলিউড হিলস। যেই পর্বতে তাকালে এক নিমিষেই বিশ্ববাসী বুঝে নেয় এখানে পৃথিবীর সেরা সেরা ছায়াছবি নির্মিত হয়। পর্ণসহ, উগ্রতা, ক্ষিপ্রতা, বিনোদন, এ্যাকশান সব ধরণের চলচ্চিত্র যেখানে নির্মিত হয় সেখানেই ভয়াবহ দাবানলের আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসের বিশাল অংশ। হলিউডের প্রাণকেন্দ্রের অধিকাংশ এলাকা ঘন ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। সড়কের পাশে সারিবদ্ধ উঁচু উঁচু পামগাছের চূড়া কদাচিৎ দেখা যাচ্ছে।
আগুন থেকে সামান্য দূরের সড়কে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা। নিশ্বাস নিতে জামা দিয়ে মানুষ তাঁদের মুখ ঢেকে রাখছেন। অনেকে ব্যাগ ও স্যুটকেস হাতে যাওয়ার জায়গা খুঁজছেন। কিছু মানুষকে রাস্তায় পায়জামা পরা দেখা গেছে। হলিউডের বিখ্যাত সড়ক সানসেট বুলেভার্ডে স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় দাবানল শুরু হয়। এতে করে হলিউডের অধিকাংশ এলাকা ঘন ধোঁয়ায় ঢেকে যায়, বাসিন্দাদের সরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। বুধবার স্থানীয় সময় মধ্যরাত নাগাদ একটি এলাকার প্রায় ৬০ একর পুড়ে গেছে। বিবিসির সাংবাদিক সরেজমিন হলিউডের অবস্থা ঘুরে দেখেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, হলিউডে গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি অনেক মানুষকে যা পারে, তা নিয়ে নিজেদের ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে দেখেছেন। গাড়ি থেকে বের হয়ে (কয়েকটি স্থানে) বিবিসির সাংবাদিক মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। ভয় ও উদ্বেগ নিয়ে কিছু মানুষ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। আনা ওয়াল্ডম্যান নামের এক নারী বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আপনি কি এখানে মানুষকে সাহায্য করতে এসেছেন? আমি কোথায় যাব? নিরাপদ জায়গা কোথায় আছে?’ বিবিসির খবরে বলা হয়, ‘মাথার ওপর দিয়ে সাইরেন বাজছে এবং হেলিকপ্টারের ডানা ভনভন শব্দ করছে।’
বৃহস্পতিবার সেখানে পাচটি সক্রিয় দাবানলে পুড়ছিল সবকিছু। এরমধ্যে ইটন নামে একটি দাবানল গতকাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এ দাবানলটি ১৭ হাজার ৬০০ একর জায়গাজুড়ে ছড়িয়েছিল। শক্তিশালী বাতাস, শুষ্ক আবহাওয়া এবং পানির চাপ কম থাকায় আগুনের তীব্রতা শুধু বাড়ছিল। দাবানলে পুড়ে গেছে হলিউড হিলসও। সেখানকার বাসিন্দাদের নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। সানসেট নামের দাবানলে জ্বলছে হলিউড হিলস। যেখানে বিখ্যাত হলিউড সাইনবোর্ডটি অবস্থিত। স্থানীয় সময় বুধবার সেখানকার সাধারণ মানুষকে সরে যেতে বলা হয়। এরপরই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। ভয়াবহ এ আগুনে হলিউডের বেশ কয়েকজন তারকার বাড়ি পুড়ে গেছে। এছাড়া হার্স্ট এবং লিডিয়া নামের দুটি ছোট আকৃতির দাবানলও লস অ্যাঞ্জেলসে জ্বলছে। ইটনের পর সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে পালিসাদেস দাবানলটি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটিও কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আগুনের তীব্রতা বেশি থাকায় বিভিন্ন শহর থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দাবানলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্যালিসাদেস। সেখানে এমন কিছু নেই যা আগুনে পোড়েনি। প্যালিসাদেসের সানসেট নামের সড়ক, যেটি লস এঞ্জেলসের মধ্যে দিয়ে মাইলের পর মাইল গেছে। সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, যেসব ব্যাংক, ক্যাফে, সুপারমার্কেটে তাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সেগুলার সবই পুড়ে গেছে। মাইকেল পায়টন নামের এক ব্যক্তি সংবাদমাধ্যম লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসকে বলেন, পুরো প্যালিসাদেস ধ্বংস হয়ে গেছে। পুরো শহরটি শেষ। এটি পুরোপুরি একটি বিপর্যয়। গত কয়েকদিন ধরেই সেখানকার আবহাওয়াবিদরা দাবানলের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছিলেন। তারা বলছিলেন, আবহাওয়া বেশ শুষ্ক হয়ে পড়েছে। তাদের সেই সতর্কতা সত্যি হয়ে এখন সেখানে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা গেছে বাড়ির পর বাড়ি, গাছপালা সবকিছু দাবানলে দাউদাউ করে জ্বলছে। এই আগুন নেভাতে সেখানে বর্তমানে ৭ হাজার ৫০০ ফায়ারকর্মী কাজ করছেন। দাবানলের কারণে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দুর্ভোগে পড়েছে পোষা প্রাণীরাও। এসব প্রাণীর জন্য নিরাপদ আশ্রয় পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মালিকদের। এরমধ্যে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। তারা তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে প্রাণীদের রাখতে দিচ্ছে। এছাড়া কিছু হোটেল বিপদগ্রস্ত মানুষকে কমমূল্যে রুম ভাড়া দিচ্ছে। সঙ্গে পোষা প্রাণীদেরও রাখার সুযোগ দিচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার অগ্নি বিশেষঞ্জ শেড হ্যানসন বিবিসিকে বলেছেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটি তাকে বেশ অবাক করেছে। আগুন এতটাই ছড়িয়েছে যে কোনো কোনো জায়গার সব ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি ছাই হয়ে গেছে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ফায়ার ফাইটাররা যখন দাবানলটির তীব্রতা দেখল তখন তারা এটি নিয়ন্ত্রণ করার বদলে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার কাজটি করলো। এখন পর্যন্ত দাবানলের আগুনে পাচজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে যদি শুরু থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে না নেওয়া হতো তাহলে সংখ্যাটি কয়েকশ হতে পারত। লস অ্যাঞ্জেলসের দাবানলের কারণে ইতালি সফর বাতিল করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি জানিয়েছেন, আপাতত তিনি এই বিপর্যয়ের ওপর নজর রাখবেন। বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে দাবানলে ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত সহায়তা করবেন।
এদিকে দাবানলের আগুনের কারণে সেখানে স্বাস্থ্যগত ঝুকিও তৈরি হয়েছে। অন্তত দুটি পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষকে কলের বদলে বোতলজাত পানি পানের আহ্বান জানিয়েছে। অ্যান রিমিয়ন নামের এক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেছেন, আগুনের দাহ থেকে যে সূক্ষ্ম কণা পদার্থ বের হয়, সেটি অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। তিনি সতর্কতা দিয়ে বলেছেন, দাবানল থেকে যারা দূরে আছেন তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ আগুনের এসব কণা ফুসফুস এমনকি ধমনীতে পর্যন্ত প্রবেশ করে যে কাউকে অসুস্থ করে দিতে পারে। খবর বিবিসি, সিএনএনের।