খেলাধুলা

যে পরিকল্পনায় জয় পেয়েছে ভারত!

স্পোর্টস ডেস্ক : দুটি ছক্কা দুটি চার। এক ওভারেই ২৪ রান। আকসার প্যাটেলকে ছাতু বানিয়ে দোদুল্যমান থাকা ম্যাচটি এক ওভারেই পিটিয়ে নিজেদের মুঠোয় নিয়ে এলেন হাইনরিখ ক্লসেন। কেনসিংটন ওভালের গ্যালারির ভারতীয় উচ্ছ্বাস থেমে গিয়ে তখন নেমে আসে নীরবতা। ভেসে আসে কেবল গুটিকয় প্রোটিয়া দর্শকের উল্লাস-ধ্বনি। হবেই না কেন? ৩০ বলে প্রয়োজন ৩০ রান, উইকেট বাকি ৬টি। দক্ষিণ আফ্রিকার জয় তো ¯্রফে সময়ের ব্যাপার! কিন্তু ভিন্ন ভাবনা ছিল রোহিত শার্মা, জাসপ্রিত বুমরাহ, হার্দিক পান্ডিয়াদের। কিন্তু হারার আগে হার নয়, শেষের আগে ছাড় নয়। এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ছিলেন তারা। তুমুল চাপের মধ্যে স্নায়ুচাপ ধরে রেখে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই ঘুরে দাঁড়ানোর সেরা গল্পগুলোর একটি লিখলেন তারা। পরের পাঁচ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা উইকেট হারাল চারটি, রান তুলতে পারল কেবল ২২। পরাজয়ের কিনারা থেকে জয়ের তীরে পৌঁছে গেল ভারত। ম্যাচের পর অধিনায়ক রোহিত শার্মা বললেন, পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা ছিল তাদের। কুইন্টন ডি কক ৩১ বলে ৩৯ রান করে ফেরার পর দক্ষিণ আফ্রিকার দায়িত্ব বর্তায় ক্লসেন ও ডেভিড মিলারের কাঁধে। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই কুলদিভ ইয়াদাভকে ছক্কা ও চার মারেন মিলার। এরপর আকসারের ওভারে ওই তা-বে দলকে শিরোপার কাছে এগিয়ে নেন ক্লসেন। প্রথম ১০ ওভারে ৮১ রান করা দক্ষিণ আফ্রিকা পরের ৫ ওভারে তোলে ৬৬ রান। সমীকরণ নেমে আসে ৩০ বলে ৩০ রানে। ম্যাচ শেষে রোহিতের দাবি, ওই সময়ও হাল ছাড়েননি তারা। “(দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের) মাঝপথে আমরা বেশ ভালোভাবে ম্যাচে ছিলাম। পরের পাঁচ ওভার আমাদের পক্ষে আসেনি। ক্লসেন ও মিলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ডি ককও নিজের ভূমিকা পালন করে। আমরা জানি যে, ব্যাট হাতে ওদের সামর্থ্য কতটা, আমরা সেটি বুঝি।” “তবে সবার জন্য বার্তাটা পরিষ্কার ছিল, শেষ বলের আগ পর্যন্ত ম্যাচ শেষ নয়। কারণ ক্রিকেটে এটাই হয় এবং বিশ্বাসটা রাখতে হবে। অধিনায়ক হিসেবে আমার কাজ এটা, সবার মধ্যে বিশ্বাসটা আনা।” সেই বিশ্বাসের বার্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা শুরু করেন বুমরাহ। ষোড়শ ওভারে আক্রমণে ফিরে মাত্র ৪ রান দেন তিনি। সেখান থেকেই শুরু হয় ভারতের ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। বুমরাহর সঙ্গে দুর্দান্ত বোলিং করেন আর্শদিপ, পান্ডিয়ারা। শেষ ওভারে লং অন সীমানায় অবিশ্বাস্য এক ক্যাচে ম্যাচের ফল প্রায় চূড়ান্ত করে দেন সুরিয়াকুমার ইয়াদাভ। পিছিয়ে পড়ার সময়গুলোতে বারবার লড়াইয়ের মন্ত্রে উজ্জীবিত থাকার কথাই বলেন রোহিত। “যখনই আমাদের হাতে বল ছিল, উইকেট পাই বা না পাই, আমরা লড়াই করতে চেয়েছি। ম্যাচে এগিয়ে থাকি বা পিছিয়ে, লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছি। আমরা লড়াই ধরে রাখতে চেয়েছি কারণ এমন মুহূর্ত আর আসবে না। এটি ফাইনাল ম্যাচ। তাই শরীর, মন আর সবকিছুতে যা কিছু আছে, সবটা দিয়ে দিতে হবে।” “তাই সবার জন্য এই বার্তাই ছিল, সবকিছু মেলে ধরো, শরীর ও মনের সবটুকু নিংড়ে দাও, এরপর দেখা যাক কী হয়। সবার মধ্যে শেষ বল পর্যন্ত ওই বিশ্বাসটা ছিল যে, আমরা লড়াই করব। যদিও ১৫ ওভার শেষে আমরা পিছিয়ে ছিলাম, যখন তাদের ৪-৫ ওভারে ৩০ রান প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বিশ্বাসটা আমাদের ঠিকই ছিল। আমরা লড়াই করতে চেয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত বাধাটা পার করতে পেরেছি।” বুমরাহর চার রানের ওই ওভারের পর হাঁটুর চোটে মাঠেই একটু চিকিৎসা নিলেন রিশাভ পান্ত। ম্যাচ থমকে থাকল কিছুক্ষণ। ক্লসেনের মনোযোগও হয়তো নড়ে গেল। পান্ডিয়ার পরের ওভারে অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের স্লোয়ার ডেলিভারি জায়গায় দাঁড়িয়ে তাড়া করে উইকেটের পেছনে ধরা পড়লেন ক্লসেন (২৭ বলে ৫২)। ওই ওভারে রান এলো মাত্র চার। তবু মিলার ক্রিজে থাকায় আশাও ভালোভাবেই ছিল প্রোটিয়াদের। তবে বুমরাহর পরের ওভারেই ম্যাচ হেলে যায় ভারতের দিকে। চতুর্থ বলে দুর্দান্ত ইনসুইংয়ে মার্কো ইয়ানসেনকে বোল্ড করেন তিনি। ওই ওভারে তার খরচ মাত্র ২ রান। শেষ দুই ওভারের জন্য ২০ রান রেখে নিজের ৪ ওভারে ১৮ রানে ২ উইকেটের স্পেল শেষ করেন তিনি। ম্যাচ শেষে রোহিত বললেন, মাঠের তীব্র বাতাসের সুবিধা কাজে লাগিয়ে সে অনুযায়ী ফিল্ডিং সাজান তিনি। “যখন বুমরাহ ১৮তম ওভারে বোলিংয়ে এলো, আমরা যেমন উইকেট নিতে চাচ্ছিলাম, তেমনি ডট বল করে চাপও সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলাম। তাই সঠিক জায়গায় ফিল্ডার রাখা জরুরি ছিল। লং অন, লং অফের ফিল্ডার ভেতরে রাখা, স্কয়ারের ফিল্ডারদের সামনে রাখা, কারণ উইকেটের আচরণের কাছে আমার মনে হয়েছে, এই পিচে ব্যাটসম্যানদের জন্য স্কয়ারে খেলা কঠিন।” “বুমরাহর অ্যাঙ্গেল ও রিভার্স সুইংয়ের কারণে সোজা ব্যাট চালানো সহজ ছিল। আমরা জানতাম, যদি স্টাম্প বরাবর বোলিং করা যায়, তাহলে রান করা কঠিন হয়ে যাবে। আর তখন তারা যদি বলের লাইন বুঝে না খেলে ভুল করে, তাহলে উইকেটের সুযোগও আসবে।” বুমরাহর স্পেল শেষ হওয়ার পর বাকি দায়িত্ব পড়ে আর্শদিপ সিং ও পান্ডিয়ার কাঁধে। ১৯তম ওভারে আঁটসাঁট লাইন-লেংথ ও গতির বৈচিত্র কাজে লাগিয়ে মাত্র ৪ রান দেন আর্শদিপ। ফাইনালে দুটিসহ সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ ১৭ উইকেটের রেকর্ড স্পর্শ করেন তরুণ বাঁহাতি পেসার। চাপের মুহুর্তে আর্শদিপের ওই ওভারের কথাও আলাদাভাবে বলেন ভারত অধিনায়ক। “(অষ্টাদশ ওভারে) প্রথম বলেই মিলারকে প্রায় বোল্ড করে দিয়েছিল বুমরাহ। পরে সে মার্কাসের (ইয়ানসেন) উইকেট নেয়। সেটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওই ওভারটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এরপর আর্শদিপও অসাধারণ বোলিং করে। সে মাত্র ৩ রানের (৪) ওভার করে। এবং শেষে ১৬ বা ১৭ রান প্রয়োজন ছিল।” শেষ ওভারে ১৬ রানের সমীকরণে ভারতের জয়ের পথে একমাত্র বাধা ছিলেন মিলার। তার নাগালের বাইরে করার চেষ্টায় প্রথম বলটি ওয়াইড ফুল টস করেন পান্ডিয়া। উড়িয়ে মারেন মিলার। মনে হচ্ছিল, সীমানা পার হয়ে যাবে বল। কিন্তু দড়ির ঠিক সামনে অসাধারণ এক ক্যাচ নেন সুরিয়াকুমার। প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় ভারতের জয়। বাকি পাঁচ বলে ভুল করেননি পান্ডিয়া। ৮ রানের বেশি নিতে পারেনি প্রোটিয়ারা। চাপের মুহূর্তে পান্ডিয়ার এমন পারফরম্যান্সের প্রশংসায় পঞ্চমুখ রোহিত। “(শেষ ওভারে) পরিকল্পনা ছিল, মিলারের নাগালের বাইরে বোলিং করার, তাকে তার আয়ত্বের মধ্যে দেওয়া যাবে না। এরপর তো সুরিয়া অসাধারণ ক্যাচ নিল। বাকি ব্যাটসম্যানদের জন্য ¯্রফে প্রয়োজন ছিল স্টাম্প বরাবর ফুল লেংথে, কোনো জায়গা না দিয়ে বল করা।” “হার্দিককে খুবই স্থির ছিল দেখে ভাল লেগেছে। যত রানই দরকার পড়ুক না কেন, ওভারটি শেষ করতে হবে এবং ভালো করতে হবে। তার সেই ওভার বোলিং করা এবং মিলারের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেওয়া দলের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই জরুরি ছিল।”

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button