সম্পাদকীয়

মানিকগঞ্জের নদীভাঙন: অব্যবস্থাপনা নাকি নিয়তির শিকার?

বর্ষা এলেই দেশের নদীবেষ্টিত এলাকাগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেই আতঙ্কের নাম-নদীভাঙন। মানিকগঞ্জ জেলা যেন প্রতিবছর এই ভয়াবহতার এক পরিচিত চিত্র হয়ে উঠেছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা, যমুনা, ধলেশ^রী, কালীগঙ্গা, ইছামতীসহ অন্তত ১৪টি নদী বেষ্টিত এই জেলার চরাঞ্চলগুলোতে বছরের পর বছর ধরে নদীভাঙন চলছে। কিন্তু ভাঙনের প্রকোপ রোধে কোনো টেকসই পরিকল্পনা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। দৌলতপুর, সাটুরিয়া, সদর ও হরিরামপুর উপজেলার একাধিক এলাকায় ভাঙনের চিত্র ভয়াবহ। ভাঙনপ্রবণ এলাকার মানুষজন আগেই জানেন তাদের বসতভিটা, ফসলি জমি, এমনকি অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে। এক ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা ভাষ্য, “আগুনে পুড়লেও কিছু থাকে, নদীতে ভাঙলে কিছুই থাকে না।” এ কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে নদীভাঙনের ভয়াবহতা ও চরম অসহায়ত্ব। এখন প্রশ্ন হলো, এই বিপদ কি অনিবার্য? নাকি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার ফল? পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ভাঙন রোধে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে এবং কিছু স্থানে ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে। তবে, বছর বছর একই প্রক্রিয়া-“বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে”, “সম্ভাব্যতা যাচাই হচ্ছে”-এই চক্র থেকে যেন বের হতেই পারছে না প্রশাসন। অথচ বাস্তবতা হলো, নদীভাঙনে জমি হারিয়ে শত শত পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, সমাজের মূলধারার বাইরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে তাদের। নদী ভাঙন রোধে শুধু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ পরিকল্পনা। প্রতিবছর সাময়িক জিও ব্যাগ ফেলে সামান্য স্বস্তি দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তা ভাঙন প্রতিরোধ নয়, বরং ‘আপাত শান্তির আশ^াস’ মাত্র। দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষামূলক বাঁধ, নদীর প্রবাহপথ পুনঃনির্ধারণ, ¯্রােতের দিক বিবেচনায় করে নির্মাণকাজ এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন আজ সময়ের দাবি। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি নদীপাড়ের মানুষদের পুনর্বাসন, সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবিকার স্থায়ী বন্দোবস্ত নিশ্চিত করাও জরুরি। যারা জমি হারিয়েছেন, তাদের কেবল এককালীন সাহায্য নয়, দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা প্রাপ্য। অবশেষে, এই প্রশ্ন থেকেই যায়: বর্ষা কি আমাদের জন্য শুধুই প্রকৃতির নিয়ম, নাকি রাষ্ট্রের উদাসীনতার ফলেও তা দুর্যোগে পরিণত হচ্ছে? মানিকগঞ্জবাসীর কাছে বর্ষা মানে নদীর উৎকর্ষ নয়, বরং জীবনের অনিশ্চয়তা। এই বাস্তবতা বদলাতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, টেকসই প্রকল্প এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ। নইলে নদীভাঙনের ইতিহাস শুধু মানচিত্রে নয়, মানুষের মনের গভীরে ক্ষতের চিহ্ন হয়ে থেকে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button