সড়কে ঝরছে লাশের মিছিল: কখন থামবে মৃত্যুর এই মারণযাত্রা?

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যেন এক অনিবার্য নিয়তির নাম। মে মাসে যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে-মোট ৫৯৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬১৪ জন, আহত হয়েছেন ১ হাজার ১৯৬ জন। সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ৬৫২টি, তাতে নিহত হয়েছেন ৬৫৮ জন। এই পরিসংখ্যান শুধু ভয়াবহই নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো-মে মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৫৬ জন। এই একটি বাহনেই প্রাণ গেছে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ৪১ দশমিক ৬৯ শতাংশের। দিন দিন বাড়তে থাকা মোটরসাইকেল ব্যবহার, তরুণদের বেপরোয়া গতির প্রবণতা, ট্রাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহনের বিস্তার-সব মিলে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। অথচ, এই দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিচয় বিশ্লেষণ করলে আরও গভীরতর বাস্তবতা সামনে আসে-নিহতের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, নারী, শিশু, পরিবহন শ্রমিক, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাও। কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই নিরাপদ নয়। যে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে (১৩৯টি), সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও দুর্ঘটনার শিকার হতে দেখা গেছে। বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনার প্রায় অর্ধেকই গাড়িচাপা দেওয়ার কারণে এবং এক চতুর্থাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটেছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতেই সর্বাধিক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। অথচ এই মহাসড়কগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ও সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বও সরকারের। এ বাস্তবতা আমাদের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ত্রুটিপূর্ণ অবস্থা এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতা সামনে আনে। সরকার প্রতিবছর রোড সেফটি স্লোগান দেয়, সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালায়, আইন কঠোর করে; কিন্তু কার্যকর বাস্তবায়ন নেই বলেই মৃত্যু কমছে না। মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে বাস, ট্রাক, ইজিবাইক-প্রতিটি পরিবহনে রয়েছে অব্যবস্থাপনা, চালকের অদক্ষতা, লাইসেন্সহীনতা ও নিয়ম না মানার প্রবণতা। সেই সঙ্গে পথচারীর অসচেতনতা ও দুর্ঘটনার পর জরুরি সেবা বিলম্বিত হওয়া পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কেবল আইন করলেই চলবে না-আইনের প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি চালক প্রশিক্ষণ, সড়ক ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ এবং দুর্ঘটনার পর জরুরি সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি, একটি জাতীয় রোড সেফটি কমিশন গঠন করে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ তৈরি করাই হতে পারে প্রাণহানি কমানোর প্রথম পদক্ষেপ। আর যতদিন তা না হবে, ততদিন “সড়কে মৃত্যু” আমাদের প্রতিদিনকার সংবাদ থেকে কখনোই হারাবে না।