সম্পাদকীয়

ইটভাটার ধোঁয়ায় পুড়ছে কৃষকের ঘাম: দায়হীন উন্নয়ন কি টেকসই হতে পারে?

জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল রেলগেট এলাকায় ইটভাটার ধোঁয়ায় ১২০ বিঘারও বেশি বোরো ধানক্ষেত পুড়ে চিটায় পরিণত হয়েছেÑএটা কোনো নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের কৃষি, পরিবেশ ও প্রশাসনিক শৈথিল্যের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ৪৫ জন কৃষক এবার ক্ষতির মুখে পড়েছেন, অথচ এমন ঘটনা নতুন নয়। স্থানীয়রা বলছেন, বিগত পাঁচ-ছয় বছর ধরেই একই ভাটার ধোঁয়া কৃষিজমিকে করে তুলেছে অনুৎপাদনশীল। কৃষি প্রধান দেশে কৃষক এখন প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করার পাশাপাশি লড়ছে মানুষেরই সৃষ্ট বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের মধ্যেও তারা যখন বোরো ধানের মতো মৌসুমি ফসলের আশায় দিনরাত ঘাম ঝরান, তখন শিল্পোৎপাদনের নামে একটি অনুমোদিত অথবা নিয়ন্ত্রণহীন ইটভাটা তাদের সেই শ্রম নিমিষে ধ্বংস করে দেয়। তাদের অভিযোগ অস্বীকার করে ইটভাটা মালিক ‘দেখে নেওয়ার’ আশ^াস দিলেও, বাস্তবে বছরে বছরে ফসল পুড়ে যাচ্ছে, ক্ষতিপূরণ মিলছে না। উপজেলা কৃষি বিভাগের প্রাথমিক তদন্তও বলছে, ইটভাটার ধোঁয়ার পাশাপাশি গরম আবহাওয়া ধানের ক্ষতির মূল কারণ। তাহলে প্রশ্ন ওঠেÑবারবার এমন ঘটনার পরও কেন সেই ইটভাটা বন্ধ করা হয়নি? কেন স্থানীয় প্রশাসন বা পরিবেশ অধিদপ্তর আগেভাগে ব্যবস্থা নেয়নি? পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী, কৃষিজমির ৩ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন আইনত দ-নীয় অপরাধ, তবু এমন ভাটা চালু থাকে কীভাবে? এই ঘটনার পেছনে যে শুধু ইটভাটা মালিকের দায় আছে তা নয়, দায় আছে নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ঘাটতিরও। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা এ অবস্থার প্রতিবাদে অতীতে রাস্তা অবরোধ করতে বাধ্য হয়েছেন। এবারও তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন, কিন্তু সেটি কতটা ফলপ্রসূ হবে তা সময়ই বলবে। একটি বিষাক্ত ধোঁয়া কেবল ফসল নয়, ধ্বংস করছে আস্থার ভীতও। কৃষকদের কণ্ঠে এখন হতাশার প্রতিধ্বনিÑ‘পাঁচ বছর ঘরের ধানের ভাত খেতে পারি না।’ এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও অশনিসংকেত। আমরা যদি সত্যিই কৃষিকে ‘মেরুদ-’ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে এই মেরুদ-ে প্রতি বছর এমন আঘাত মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের উচিত হবে দ্রুত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা এবং আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে দায়ী ইটভাটা বন্ধ করা। পাশাপাশি, ভবিষ্যতের জন্য কৃষিজমির চারপাশে দূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি কার্যকর রূপরেখা বাস্তবায়ন করা দরকার। অন্যথায়, আমরা শুধু ফসল নয়Ñহারাবো কৃষকের ভরসা, হারাবো টেকসই উন্নয়নের ভিত্তিও।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button