সম্পাদকীয়

প্রবাসী নারী শ্রমিকদের অনাকাক্সিক্ষত মাতৃত্ব – নীরব ট্র্যাজেডি ও সম্ভাবনার দ্বন্দ্ব

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারী অভিবাসী শ্রমিকদের অবদান ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু এই অর্জনের আড়ালে চাপা পড়ে আছে এক নির্মম বাস্তবতা-বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণে বাধ্য হন। এই নারীরা দেশে ফিরে আসার পর সম্মান রক্ষার তাগিদে গোপনে গর্ভপাত করান বা নবজাতককে ফেলে রেখে যান। সমাজ ও পরিবার তাদের গ্রহণ করে না, ফলে তারা নিঃসঙ্গ, মানসিকভাবে ভেঙে পড়া, এবং অনেক সময় জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দেন। এই নীরব ট্র্যাজেডি আমাদের অভ্যন্তরীণ সামাজিক কাঠামো ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন ব্যবস্থার বড় এক ত্রুটি প্রকাশ করে। অনেকেই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মে নিযুক্ত থেকে নিপীড়নের শিকার হন। অনেকেই গর্ভধারণ করেন, কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক চাপে পড়ে গোপনে গর্ভপাত করান, যা স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি মানসিকভাবে তাদের বিপর্যস্ত করে তোলে। ঢাকার আহ্ছানিয়া মিশনের মতো কিছু সংগঠন এই ধরনের নারী ও তাদের অনাকাক্সিক্ষত সন্তানদের আশ্রয় ও সহায়তা দিলেও সরকারি সহযোগিতা এখনও খুবই সীমিত। আহ্ছানিয়া মিশনের তথ্যমতে, প্রতিবছর গড়ে ২০-২৫ জন নারী সাহায্যপ্রার্থী হয়ে আসে। এদের মধ্যে অনেকেই শেষ পর্যন্ত নবজাতক সন্তানকে পরিত্যাগ করে দান করেন দত্তকপ্রত্যাশী দম্পতিদের কাছে। এই মানবিক দায়িত্ব পালন করছে কিছু বেসরকারি সংগঠন, যারা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব শিশুদের নতুন পরিবারে ঠাঁই দিতে সক্ষম হচ্ছে। অথচ, এটি হওয়া উচিত ছিল একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সমস্যার গভীরে রয়েছে সমাজে নারী শ্রমিকদের প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঘাটতি এবং বিদেশে কর্মরত নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়ভারহীনতা। অন্যদিকে, দেশে ফেরত আসা এসব নারীকে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক পুনর্বাসন এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কার্যকর উদ্যোগ। এসব ভিকটিমের পরিবার ও কমিউনিটিকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে সহানুভূতিশীল সামাজিক কাঠামো। রাষ্ট্র ও সমাজকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে-আমরা কি এই নারীদের অপরাধী হিসেবে দেখব, নাকি নিপীড়নের শিকার হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়াব? অভিবাসন নীতিতে নারী শ্রমিকদের বিশেষ সুরক্ষা নিশ্চিত করা, গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে অধিকার রক্ষা করা এবং দেশে ফিরলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি। এই সংকট একদিকে যেমন নারীর মর্যাদা ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার প্রশ্ন, অন্যদিকে তেমনি শিশুর জীবনের অধিকার ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন। অনাকাক্সিক্ষত হলেও এদের জন্ম হয়েছে, এদেরও বাঁচার অধিকার আছে-এ সত্যটি মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button