খুলনা জুড়ে অবৈধ অ্যাম্বুলেন্সের ছড়াছড়ি

সেবার নামে চলছে ব্যবসা-নৈরাজ্য, হরতাল অবরোধেও নির্বিঘেœ সুস্থ লোককে রোগী সাজিয়ে ভাড়া টানার মত অভিযোগ আছে, খুলনায় জেলায় বৈধ অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ৯৩, সিটিতে আছে ১৩টি, খুমেক হাসপাতালের সামনে ১০০-১২০টি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সব সময় থাকে, কেসিসি রাস্তা দখলমুক্ত রাখতে ফুটপাত বা রাস্তায় অবৈধ চা-দোকানী উচ্ছেদ হলেও বহাল তবিয়াতে আছে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীরা
কামরুল হোসেন মনি ঃ মুর্মুষু রোগী পরিবহনের মতো একটি সংবেদননশীল কাজ অ্যাম্বুলেন্স সেবায় খুলনা নগর ও উপজেলাগুলোতে চলছে নৈরাজ্য আর বাণিজ্য। সরকারি খাতে যেমন রয়েছে নানা অনিয়ম, তেমনি বেসরকারি খাতেও চলছে স্বেচ্ছাচার। একক ব্যক্তির মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স বৈধ নয়। এগুলোকে কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলাচল করতে হবে। কিন্তু এসব কোন কিছুরই তোয়াক্কা না করেই রোগী পরিবহনের মতো কোনো সুবিধা ছাড়াই সাধারণ মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে পথে নামিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তারা মানছেন না কোনো নিয়ম-নীতি। আর এগুলো চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। বিআরটিএ দায় চাপায় পুলিশ প্রশাসনের ওপর, পুলিশ প্রশাসন বলছে বিআরটিএ’র কথা। খুলনা সিটি ও উপজেলাগুলোতে বিআরটিএ রেজিস্ট্রেশনকৃত বৈধ অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ১০৬টি। খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের সামনে আছে ১০০-১২০টি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। আছে ব্যক্তি মালিকানাধীন নামে অ্যাম্বুলেন্স যা অবৈধ, আছে হাসপাতালে চাকুরিরত ব্যক্তির নামেও অ্যাম্বুলেন্স। এগুলোকে কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলাচল করতে হবে।” অন্যদিকে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা সংখ্যায় অপ্রতুল। এছাড়া বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের মালিক-চালকদের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়াটাও অনেক কঠিন। ৫০০ শয্যা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২৫০ শয্যা খুলনা জেনারেল হাসপাতাল, শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল ঘুরে দেখা গিয়েছে এসব হাসপাতালের রোগী পরিবহনে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবহার তেমন একটা হচ্ছে না, যা চোখে পড়েছে তার বেশির ভাগই বেসরকারি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালক জানান, দীর্ঘদিন ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছেন তিনি। এক হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার সঙ্গে আরেক হাসপাতালের মিল নেই। সবচেয়ে বেশি ভাড়া গুণতে হচ্ছে মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে।
অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে নানা সময়ে দুর্ভোগ পাওয়া নগরীর কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা তার বিন্দুমাত্রও নেই। অধিকাংশ বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে নেই রোগী ও চিকিৎসকের বসার জন্য আসন, সচল অক্সিজেন সিলিন্ডার ও প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম। সাধারণ মাইক্রোবাসের মতো যাত্রী বসার সিট ছাড়া আর কিছুই নেই। এ বিষয়ে কথা হয় খুলনা মহানগরীর একাধিক অ্যাম্বুলেন্স চালকদের সঙ্গে। তাতে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। জানা গেছে, সরকারি হাসপাতাল ও কয়েকটি উঁচু মানের বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ছাড়া অধিকাংশ অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করা হয়েছে মাইক্রোবাস কেটে। ফলে এসব অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলো নেই। আছে শুধু যাত্রী বসার আসন। রোগী নেওয়ার সময় সিট টেনে হাসপাতালের ট্রলিসহ এসব মাইক্রোবাসে ঢুকিয়ে নেয়া হয়। রোগী না থাকলে সিট বসিয়ে দিয়ে যাত্রী আনা-নেওয়া করা হয়। অ্যাম্বুলেন্স দেখলে সাধারণ যেকোনো যানজট থেকে সহজে ছাড়া পাওয়া যায়। হরতাল অবরোধেও নির্বিঘেœ চালানো যায়। এ সময় সুস্থ লোককে রোগী সাজিয়ে ভাড়া টানা যায়। পুলিশসহ প্রশাসনের কেউ অ্যাম্বুলেন্সের দিকে নজর দেয় না। খুলনা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে বর্তমানে খুলনা জেলায় অ্যাম্মুলেন্স রয়েছে ১০৬ টি। এর মধ্যে খুলনা সিটিতে আছে ১৩টি এবং জেলায় রয়েছে ৯৩ টি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) খুলনা সহকারি পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মো: তানভির আহমেদ বলেন, “খুলনা সিটি ও জেলায় মিলে মোট রেজিস্ট্রেশনকৃত অ্যাম্বুলেন্স সংখ্যা রয়েছে ১০৬টি। লক্কড়ঝক্কড় অ্যাম্বুলেন্স ও অন্য যানকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করে কেউ কেউ এ ব্যবসা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এ ধরনের অ্যাম্বুলেন্স রোগীর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একক ব্যক্তির মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স বৈধ নয়। এগুলোকে কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলাচল করতে হবে।”
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করার আগে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ’র) অনুমোদন লাগে। একইভাবে বেসরকারি খাতেও বিআরটিএ’র অনুমোদন ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালুর কোনো নিয়ম নেই। সরকারি বিধি অনুযায়ী, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের গাড়িতে রোগী ও চিকিৎসকের জন্য থাকতে হয় বিশেষ আসন বা শয্যা। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য থাকবে সচল অক্সিজেন সিলিন্ডার ও প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জামের বাক্স। রোগীর অন্তত একজন স্বজন বসার ব্যবস্থা থাকবে। তা ছাড়া অ্যাম্বুলেন্সের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই খুলনা জুড়ে চলছে সিংহভাগ অ্যাম্বুলেন্স। এর একটি বড় অংশ রয়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের সামনে। এখানেই আছে প্রায় ১০০-১২০ টি অ্যাম্বুলেন্স। অধিকাংশই এ সব অ্যাম্বুলেন্সে নেই ফিটনেস। অনেকেরই একক ব্যক্তির মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এগুলোকে কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলাচল করতে হবে। কিন্তু এসব কোন কিছুই তোয়াক্কা না করেই। রোগী পরিবহনের মতো কোনো সুবিধা ছাড়াই সাধারণ মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে পথে নামিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। খুমেক হাসপাতালের সরকারি অনেক স্টাফদের ব্যক্তিগত অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে ‘অ্যাম্বুলেন্স’ লেখা থাকলেও আসলে বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। তবে কিছু অ্যাম্বুলেন্সের বিআরটিএ’র অনুমোদন রয়েছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ ( কেএমপি) ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ( ট্রাফিক) মনিরা সুলতানা বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের কোন অভিযোগ নেই। আমরা সব ধরনের সড়কে ফিটনেসবিহীন পরিবহনগুলো চলাচল করলে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে বলে তিনি দাবি করেন।
এ ব্যাপারে খুলনা মেডিকেল কলেজ ( খুমেক) হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: মো: হুসাইন সাফায়ত বলেন, হাসপাতালের মধ্যে ও বাউন্ডারেরর আশে পাশে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স অবৈধভাবে জায়গা দখল করে থাকার বিষয়টি আমি সোনাডাঙ্গা মডেল থানার ওসিকে বলেছি। তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া আশ^াস দেন। তিনি বলেন, বর্তমানে এ হাসপাতালে ৫টি অ্যাম্বুলেন্স আছে। সবকয়টি বর্তমানে সচল আছে।
সোনাডাঙ্গা মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি) মো: ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, খুমেক হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আমার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। রাস্তা দখল করে অ্যাম্বুলেন্স রাখা ও সরকারি রাস্তার জায়গা দখলে থাকা অ্যাম্বুলেন্স চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, নগরে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের পাশাপাশি ব্যক্তির নামেও অ্যাম্বুলেন্স চলে। কোনো কোনো চালক তার ইচ্ছেমতো অতিরিক্ত ভাড়া নেন মুমূর্ষু রোগীর কাছ থেকে। হেরফের হলে নানা অজুুহাতে বন্ধ রাখা হয় অ্যাম্বুলেন্স। যানবাহন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেন না। চালকদের নৈরাজ্যের কথা বুঝতে পেরে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কিছু বললে উল্টো যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে মেরামতের জন্য বিল দাবি করেন তারা।
বেসরকারি চালকরা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পথে বাণিজ্য করেন। রেফার করা হাসপাতালে রোগী পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে রিজার্ভ বা লোকাল প্যাসেঞ্জার তুলে আনেন। এমনকি মদ, ইয়াবাসহ নানা অবৈধ পণ্য বহনেরও অভিযোগও পাওয়া গেছে চালকদের বিরুদ্ধে।