স্থানীয় সংবাদ

অমর একুশে আজ

একুশের প্রথম প্রহরে বিন¤্র শ্রদ্ধায় শহীদদের স্মরণ : দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি

মোঃ আশিকুর রহমান ঃ আজ বুধবার, মহান শহীদ দিবস, একই সঙ্গে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অনন্য গৌরবময় অধ্যায়, ভাষার জন্য আত্মত্যাগের অহংকারের একটি দিন ; নতুন প্রজন্মের জেগে ওঠার নতুন এক প্রেরণা। ২১শে মার্চ, ১৯৪৮ সাল। ঢাকার রেসর্কোস ময়দান তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দৃঢ় ভাষায় ঘোষনা করেন “উর্দূ এবং উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এমন ঘোষণায় আবারো সোচ্চার হয়ে ওঠে সমগ্র বাংলা। মায়ের মুখের ভাষা ছেড়ে অন্যভাষায় কথা বলার প্রশ্নই আসেনা! এভাবে অতিবাহিত হয় আরও ৪ বছর।
২৭শে জানুয়ারি, ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের নব-নিযুক্ত গর্ভণর জেনারেল খাজা নাজিম উদ্দিন ঢাকায় এসে পুনঃরায় ঘোষনা দেন, “উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষনা শোনার পর আবার গর্জে উঠে বাঙ্গালী জাতি, প্রতিবাদে জ্বলে উঠে সারা বাংলা। ২১শে ফেব্রুয়ারী সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ র্কতৃক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সাল, সকাল হতে না হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জড়ো হতে থাকে ছাত্র জনতা। পাকিস্তান সরকার ঐ দিন ঢাকায় ১৪৪ ধারা ঘোষনা করেন। একসময় সমবেত ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন এবং গাজীউল হকের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সবাই মিছিল নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিল যখন ঢাকা মেডিক্যালের কাছাকাছি আসে তখন শুরু হয় পুলিশের এলোপাতাড়ি গোলাগুলি। গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রফিক, জব্বার, সালাম ও বরকত। বুলেটের আঘাতে রফিকের মাথা ফেটে মগজ বের হয় পড়ে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে জব্বার ও বরকত ঐ দিন রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আহত অবস্থায় ২৫শে ফেব্রুয়ারী রাতে মারা যান সালাম। ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে ইউনোস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ‘আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্ব এই দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু করেন।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বাংলার দামাল তরুন সেনাদের বুকের ঢেলে দেয়া রক্তে শৃঙ্খল মুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি! যা ভোলবার নয়, সত্যিই কিছুতেই ভোলবার নয়। সেই দিনের ভাষা সৈনিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা নিজের মুখের বুলিকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি, পেয়েছি আন্তজার্তিক সম্মান। পৃথিবীর বুকে ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে জীবন বলীয়ান দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে একমাত্র বাংলার বীর সন্তানদের। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ও বাঙালির চেতনার প্রতীক। তাই রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতিবহ মহান শহিদ দিবসের সকল ভাষা শহীদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে খুলনা সর্বস্তরের মানুষ।
সারাদেশের মতো মহানগর খুলনাতেও মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রথম প্রহরে (১২টা ১ মিনিটে) শহিদ হাদিস পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরকারি, বেসরকারি, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পুষ্পমাল্য অর্পণ এবং শহিদরে আত্মার মাগফিরাত কামনার মাধ্যমে শহীদ দিবসের কর্মসূচির সূচনা হয়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারী সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি- আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সঠিক নিয়মে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হয়েছে। একই সাথে সূর্যাস্তের সাথে সাথে সাথে জাতীয় পতাকা নামানো হবে। ওই দিন শহীদ হাদিস পার্কে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ দিবসের আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া, ২০ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গনে নির্মিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালে মোমবাতি প্রজ¦লনের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। ২১শে ফেব্রুয়ারী সকাল সাড়ে ৯টায় নগর ভবনে সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে চিত্রাংকন এবং রচনা প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হবে। খুলনা মহানগর আ’লীগের উদ্যোগে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ২০ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে শহীদ হাদিস পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে, ২১ ফেব্রুয়ারী সকাল ৭টায় দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান, অতঃপর প্রভাত ফেরী এবং প্রভাত ফেরী শেষে দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। খুলনা জেলা আ’লীগের উদ্যোগে শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে অমর একুশের প্রথম প্রহরে ১২টা ১ মিনিটে শহীদ হাদিস পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে, ২১শে ফেব্রুয়ারী ভোর ৬টায় জেলা কার্যালয়সহ সকল শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা, কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় কালো ব্যাচ ধারণ এবং বিকাল ৩টায় দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। খুলনা প্রেস ক্লাবে পক্ষ হতে অমর একুশের প্রথম প্রহরে ১২টা ১ মিনিটে শহীদ হাদিস পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে, ২১শে ফেব্রুয়ারী বেলা সাড়ে ১১টায় ক্লাবের হুমায়ূন কবীর বালু মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে খুলনা মহানগর বিএনপি। ওই সকালে শহীদ হাদিস পার্কের শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করবে দলটি। বাদ যোহর সুবিধামত সময়ে সকল মসজিদে শহিদদের রুহের মাগফিরাত , দেশের শান্তি ও কল্যান কামনা করে বিশেষ দোয়া মাহফিল এবং মন্দির, গীর্জা ও অন্যান্য উপসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। ওই দিন বিকাল ৪টায় বয়রাস্থ বিভাগীয় গণ-গ্রন্থগার প্রাঙ্গনে অমর একুশে বই মেলার মঞ্চে বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সন্ধ্যা ৬টায় শহিদ হাদিস পার্কে খুলনা জেলা তথ্য অফিসের উদ্যোগে ভ্রাম্যমান চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও একুশের পোস্টার প্রর্দশনী করা হবে। দিবসদির তাৎপর্য তুলে ধরে স্থানীয় পত্রিকাগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপণায় বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মহান আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস তথা শহীদ দিবস উপলক্ষ্য প্রথম প্রহরে খুলনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে ফুল দিয়ে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। তাছাড়া ২১ শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা ৬টায় শহীদ হাদিস পার্কে শহীদ দিবসের আলোচনা সভা, সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া বই মেলায় আলোচনাসহ নানা কর্মসূচি পালিত হবে। সাবেক কাউন্সিলর এসএম হুমায়ুন কবির জানান, মাতৃভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের কাছে আমরা চির ঋনী। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ করা উচিত বলে আমি মনে করি, কারণ বাংলা ভাষা আমাদের অহংকার, অলংঙ্কার। দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষ এএসএম মোঃ আনিসুর রহমান জানান, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রথম প্রহরে শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। সকালে প্রভাত ফেরী, আলোচনা সভা ও দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। দৌলতপুর সরকারি মুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) শহিদুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার জানান, সূর্যোদয়ের সাথে সাথে পতাকা অর্ধনমিতকরণ, কালো ব্যাচ ধারন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সমান্বয়ে প্রভাত ফেরী, আলোচনা সভা, প্রতিযোগীতা, দোয়া মোনাজাতসহ নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এমনই কর্মসূচি পালনের কথা জানিয়েছেন নগরীর একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ। নাগরিক নেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শাহিন জামাল পন জানান, আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, আমরা বাঙালী। বাংলা ভাষাকে আমরা সর্বাত্বক স্তরে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা একজন নাগরিক নেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে আমার উপলব্ধি। সর্বাত্বক বাংলা ভাষা প্রয়োগে রাষ্ট্র কেবল নিজেই আইন বা নীত নির্ধারণ করলেই হবে না, রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে সর্বাত্বক বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করা নিজেরই দায়িত্ব। এখনো বিভিন্ন এনজিও, জিও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নামকরণ আগে ইংরেজীতে করছে, পরে বাংলার প্রয়োগ করছে। আমরা যদি বাংলাদেশকে বিশ^াস করি, মায়ের ভাষা বাংলাকে বিশ^াস করি তাহলে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রয়োগের চর্চা করতে হবে বলে আমি মনে করি।
খুলনা বৃহত্তর উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ মোহাম্মাদ আলী, বাংলা ভাষার জন্য রফিক, শফিক সালাম, বরকতসহ আরো অনেক শহীদই জীবন দিয়ে গেছেন। আমি মনে করি সর্বক্ষেত্রে, সর্ব পর্যায়ে, নীতি নির্ধারক পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে প্রধান্য দেওয়া উচিৎ। বাংলা ভাষা সর্বত্র প্রধান্য না পাওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের। সর্বপরি অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের মায়ের মুখের ভাষা বাংলা আজ আর্ন্তজাতিক দরবারে মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এটাই আমাদের গর্বের, আমাদের ভালো লাগার, ভালোবাসার। খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, মহান আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস তথা শহীদ দিবস উপলক্ষ্য প্রথম প্রহরে খুলনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে ফুল দিয়ে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। এছাড়া ২১ শে ফেব্রুয়ারী শহীদ হাদিস পার্কে শহীদ দিবসের আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরষ্কার বিতরনী এবং মেলায় আলোচনাসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button