ছাত্র-পুলিশ দফায় দফায় সংঘর্ষে খুলনা রণক্ষেত্র : পুলিশ কনস্টেবল নিহত

# পুলিশসহ আহত অর্ধশতাধিক # পুলিশের পিকআপ ভ্যানে আগুন #
স্টাফ রিপোর্টার : খুলনার জিরো পয়েন্ট, গল্লামারী মোড় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শুক্রবার (২ আগস্ট) বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের তিন দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এসময় সুমন কুমার ঘরামী নামে পুলিশের এক কন্সটেবল নিহত হয়েছেন। ২০ থেকে ২৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। সংঘর্ষ চলাকালে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ কন্সটেবল সুমন কুমার ঘরামী’র মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক। মো. সুমন খুলনা পুলিশ লাইন্সে কর্মরত ছিলেন। আন্দোলনকারীদের পক্ষে আল শাহরিয়ার জানান, তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ অহেতুক টিয়ারসেল ও রাবার বুলেট ছুঁড়েছে। অনেকে আহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ কয়েকজনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সঠিক সংখ্যা পরে জানানো হবে। সোনাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা থানার গেটে কিছু ইট নিক্ষেপ করেছিল। তবে কেউ আহত হননি।’ রাত পৌনে ৯টার দিকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “হামলাকারীদের অতর্কিতে হামলায় আমাদের ২০-২৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন এবং পুলিশ লাইন্সের কনস্টেবল সুমন কুমার ঘরামী নিহত হয়েছেন।
মোজাম্মেল হক আরও বলেন, পুলিশ সর্বোচ্চ ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়েছে। অথচ আমার এক ভাইকে পিটিয়ে মেরে ফেলল।” এদিকে, বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রাবার বুলেট, টিয়ায় সেলের গ্যাসে শ্বাসকষ্ট ও শটগানের ছররা গুলিতে আহত হয়ে ২১ জনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, পুলিশ সদস্য ও ফায়ার সার্ভিস এর সদস্যরা ছিলেন। এদের মধ্যে ৪ জনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সংঘর্ষে আহত পুলিশ সদস্যরা খুলনা পুলিশ হাসপাতালের পাশাপাশি নগরীর অন্য হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে সূত্র মতে, হরিণটানা থানাধীন জিরো পয়েন্ট মোড় ও গল্লামারী মোড়ে পুলিশ ও ছাত্রদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ ও শটগানের ছররাগুলি মিলে মোট ২০-২১ জন আহত খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬ জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
আহতরা হচ্ছেন খ্লুনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ডিসিপ্লি¬ন ব্যাচ নং ২১ নুরুজ্জামান নাবিল (২৫) (শট গানের ছররাগুলিতে আহত), জাহাঙ্গীর নগর বিশ্বিবদ্যালয়ের ছাত্র, আব্দুল্লাহ সাফিল (২২) (শর্ট গানের ছররাগুলিতে আহত), আবির (২০)। সে নগরীর আহসান উল্লাহ কলেজের ১ম বর্ষের ছাএ (টিআরসেল আহত, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে) গ্রীল এর দোকান ব্যবসায়ী মিজান (৩৪), বেসরকারি কোম্পানীতে চাকরিরত মোঃ সৌরভ আহম্মেদ (৩০) (বুকে, মুখে শর্টগানের ছররা গুলিতে আহত, ফায়াজ ফেরদৌস (২২) (শরীরের বিভিন্ন জায়গায় শর্ট গানের ছররাগুলি লাগে), এল এল বি মেডিটার্স ইউনিভার্সিটি এর ছাত্র আল শাহরিয়ার নিরব (২০) (টিয়ারসেলের গ্যাসে শ্বাসকষ্ট), ইসলামিয়া কলেজ এর ল্যাব এসিস্ট্যান্ট মোঃ সিরাজুল ইসলাম (৫০) (কপালে শট গানের ছররা গুলী), পাইনিয়ার গার্লস কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার্থী রাবেয়া সুলতানা রিয়া (১৭) (টিয়ার সেলের গ্যাসে শ্বাসকষ্ট), পথচারি রাশিদা পারভীন (৪৮) (শর্ট গানের ছররা গুলি মুখে), খুলনা সরকারি বিএল কলেজ, জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী তানিয়া আক্তার (১৯) (টিয়ার সেলের গ্যাসে শ্বাসকষ্ট), খুলনা ইউনিভার্সিটি (ইসিই) ২য় বর্ষের ছাত্র আবিদ (২০) (টিয়ার সেলের গ্যাসে শ্বাসকষ্ট), আহসান উল্লাহ কলেজ এর ম্যানেজমেন্টে অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী মিতু (২১) (টিয়ারসেলের গ্যাসে শ্বাসকষ্ট), শেখ তাহারজিন (২০) (টিয়ারসেলের গ্যাসে শ্বাসকষ্ট) কেএমপি পুলিশ লাইন খুলনা। কনস্টেবল, হোসাইন রাসেল (২৬) (টিয়ারসেলের গ্যাসে শ্বাসকষ্ট), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এর বাংলা ৪র্থ বর্ষ ছাত্র নাঈম (২২) (পায়ে আঘাত), খুলনা সরকারি পলিটেকনিক ১ম বর্ষের ছাত্র রেদওয়ান মুস্তাকিম (১৮) (টিয়ারসেলের গ্যাসে শ্বাসকষ্ট), বিএল কলেজ ২য় বর্ষের ছাত্র ইমরান (১৯), সুন্দরবন কলেজ ৩য় বর্ষের ছাত্র ইমন (২০) এবং কমার্স কলেজ অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র ফাহাদ ইবনে হাসান হৃদয় (২১)। তারা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সার্জারী ০৯/১০ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে শিক্ষার্থীরা খুলনা মহানগরীর নিউমার্কেটের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও পরে পিছু হটে। এরপর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে মজিদ সরণি হয়ে সোনাডাঙ্গা থানার দিকে যায়। এ সময় শিক্ষার্থীরা সোনাডাঙ্গা থানায় ইট নিক্ষেপ করে। তখন পুলিশ সদস্যরা থানার ভেতরে গিয়ে অবস্থান নেন। পরে হরিণটানা থানাতেও ইট ও খালি বোতল নিক্ষেপ করেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীরা দুপুর সোয়া ৩টার দিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছান। এসময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ এবং পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে চলে এই সংঘর্ষ। এছাড়া উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় নগরীর গল্লামারী থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিকেল ৪ টার দিকে পুলিশ কিছুটা পিছু হটে। কিছু পুলিশ জিরো পয়েন্ট এলাকায় এবং কিছু পুলিশ গল্লামারী মোড়ে অবস্থান নেয়। কয়েক দফা আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পুলিশ কিছুটা পেছনে সরে আসতে বাধ্য হয়। পরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের পর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে নগরীর শিববাড়ি মোড়ের দিকে যেতে চাইলে সন্ধ্যা ৬টার দিকে গল্লামারী মোড়ে আরেক দফা সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পুলিশ পিছু হটলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।