যে কারণে বার বার ডুবছে খুলনা!
- প্রকল্প প্রণয়নে দূরদর্শিতার অভাব
- কেসিসি’র অদক্ষ নেতৃত্ব ও প্রকৌশল বিভাগের অব্যবস্থাপনা
- কোটি কোটি টাকা ভেসে যাচ্ছে জলে
- ছয় বছরে ৫০২ কোটি টাকা ব্যয়েও সুফল নেই
- ভারী বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় অধিকাংশ এলাকা
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান : একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও কোন ভাবেই খুলনা মহানগরীকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। স্বল্প সময়ের ভারি বৃষ্টিপাতেই বার বার ডুবছে নগরী। সড়ক উপচে বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করছে পানি। জলাবদ্ধ থাকছে নি¤œ এলাকা। আর মহা-ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
এদিকে, নগরবাসীর এ দুর্ভোগের পিছনে মূল কারণ হিসেবে প্রকল্প প্রণয়নে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের দূরদর্শিতার অভাব, অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের অদক্ষ নেতৃত্ব ও প্রকৌশল বিভাগের চরম অব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে এসেছে। বিশেষ করে রূপসা ও ভৈরবসহ শহরঘেষা নদ-নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হলেও সেগুলোর ড্রেজিং বা খননের দিকে নজর না দিয়ে শুধুমাত্র নগরীর ড্রেন ভাঙ্গা-গড়ার কাজ চলছে। ফলে বৃস্টির পানিতে কোটি কোটি টাকা ভেসে গেলেও প্রকৃতপক্ষে নগরী জলজটমুক্ত হচ্ছে না।
এ অবস্থায় নগরীকে পানিমুক্ত করতে নতুন করে পাম্প হাউজ ও স্লুইজগেট নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে কেসিসি। এছাড়া প্রথম পর্যায়ের চলমান ড্রেনেজ প্রকল্পের বাকি চার ধাপ এবং পাম্প হাউজ ও স্লুইজগেট নির্মাণ শেষ হলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে রক্ষা মিলবে বলে আশা করছেন কেসিসি কর্তৃপক্ষ।
সূত্র মতে, খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) এলাকার মধ্যে সড়ক আছে প্রায় এক হাজার ২১৫টি, যার অধিকাংশই বৃষ্টি হলেই পানিতে ডুবে যায়। বৃষ্টি হলেই নি¤œাঞ্চলসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়া খুলনা নগরীর অনেক পুরোনো সমস্যা। ভারী বৃষ্টি হলেই নগরীর রয়েল মোড়, বাইতিপাড়া, মৌলভীপাড়া, টিভিবাউন্ডারী রোড, পিটিআই মোড়, টুটপাড়া জোড়াকল বাজার, মহির বাড়ি খালপাড়, রূপসা ঘাট, নতুন বাজার, গল্লামারি, গোবরচাকা নবীনগর, খালিশপুর মুজগুন্নি, বাস্তুহারা কলোনি, হাউজিং এলাকা, ফুলবাড়ি গেট, রেলিগেট, মহেশ্বরপাশা, দৌলতপুর, রায়েরমহল ও বয়রা বাজারসহ নগরীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সড়ক ও নি¤œাঞ্চল পানিতে ডুবে যায়। সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি জমে থাকায় বিপাকে পড়েন শ্রমজীবী, শিক্ষার্থী, চাকরিজীবীরা। চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে দুর্ভোগে পড়েন চালকরা। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই জনদুর্ভোগ। অথচ নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খরচ করা হয়েছে বিপুল অংকের অর্থ। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন খুলনার মানুষ। কেসিসি’র সূত্র জানান, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় গত ছয় বছরে ১০৪টি ড্রেন পুণর্নিমাণ করেছে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি)। ময়ূর নদসহ সাতটি খাল পুনঃখনন ও ৩২টি ড্রেনের সংস্কার চলছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫০২ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরও নগরীর জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এখনও সামান্য বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর নি¤œাঞ্চল। প্রধান সড়কগুলোয় তৈরি হচ্ছে জলজট। জলাবদ্ধতায় ক্ষিপ্ত নগরবাসীর অনেকে বলেছেন, বিগত ৫ বছরে খুলনায় সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের অবকাঠামো নির্মাণ ও ড্রেনের সংস্কারের জন্য নেওয়া হয়েছে একের পর এক প্রকল্প। উদেশ্য ছিল মেগা লুটপাট। গত ৫ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসন হয়নি বরং বেড়েছে। নালা রাস্তাসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজের কারণে পানি নিষ্কাশন কম হয়। ফলে আগের চেয়ে আরও বেশি পানি জমছে।
কেসিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একনেকে অনুমোদন হয় ‘খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্পটি। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৮২৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। প্রকল্প ব্যয় কমে দাঁড়ায় ৮২৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। মেয়াদ নির্ধারণ হয় ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। প্রকল্পে ড্রেন নির্মাণ, খাল খনন, স্লুইসগেট, পাম্পহাউস নির্মাণসহ ১৭৭টি কাজ করার কথা ছিল। এর মধ্যে গত ছয় বছরে ১০৪টি ড্রেন ও খালের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ চলমান রয়েছে।
সূত্রটি জানায়, ড্রেন নির্মাণ হলেও পানি নামার মূল পথ খালগুলো খননের কাজ এখনও শেষ হয়নি। বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের জন্য পাম্পহাউস নির্মাণের কাজও শুরু হয়নি। ট্রেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, শুধু ড্রেন নির্মাণ করলেই হবে না, এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বর্জ্য পড়ে অধিকাংশ নতুন ড্রেন ভরাট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে কেসিসির নজরদারি কম। সঠিকভাবে তদারকির অভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় কাজে আসছে না। কেসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাসুদ করিম বলেন, ‘খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮২ শতাংশ। খরচ হয়েছে ৫০২ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে নগরীর ১২শ’ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ কাজের মাত্র ১৩৩ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। যার অগ্রগতি মাত্র ১৩ শতাংশ। বাকি চার ধাপের কাজ করা সম্ভব হলে পুরো প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে। এছাড়া পাম্প হাউজ ও স্লুইসগেট নির্মাণ কাজ শেষ হলে বৃষ্টিতে নগরীতে পানি জমবে না বলে আশা করছেন তিনি। তবে প্রকল্পের মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ৩০ জুন করার প্রস্তাব দিলেও তা অনুমোদন হয়নি- উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, নতুন করে আবারও প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে শহরঘেষা নদ-নদীর তলদেশ ভরাটের বিষয়টি স্বীকার করলেও নদীগুলো ড্রেজিংয়ের বিষয়ে প্রকল্পে কোন প্রস্তাবনা নেই বলেও জানান প্রকল্পের প্রধান মাসুদ করিম।
এ বিষয়ে কেসিসি’র প্রধান প্রকৌশলী মো. মশিউজ্জামান বলেন, নগরীর পানি রূপসা নদীতে গিয়ে পড়ে। রূপসার তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। জোয়ারের সময় বৃষ্টি হলে পানি বের হতে পারে না, উল্টো নদীর পানি নগরীতে প্রবেশ করে। এজন্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রূপসায় একটি স্লুইসগেট ও পাম্প হাউজ নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পাম্প হাউজ মির্মাণ হলে বৃষ্টির পানি পাম্প করে নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। আর নদীর পানিও নগরীতে প্রবেশ আটকে দেওয়া হবে। ফলে নগরীতে আর বৃষ্টির পানি জমবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।