স্বাদে অতুলনীয় ফুলতলার কুমড়ার বড়ি বিখ্যাত কুমড়ো বড়ি যাচ্ছে বিদেশেও
সাইফুল্লাহ তারেক ঃ ফুলতলার তৈরি বিখ্যাত কুমড়ো বড়ি যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ফলে কুমড়ো বড়ি বদলে দিয়েছে গ্রামীন অর্থনীতি। শীতকালের ভিন্ন পদের খাবার হিসেবে দেশে রয়েছে এর প্রচুর চাহিদা। আর এই চাহিদা পূরণে কাজ করে যাচ্ছে ফুলতলার প্রায় ১ থেকে দেড় হাজার নারী। ফুলতলা উপজেলার গ্রামীণ নারীরা মৌসুমি খাদ্য হিসেবে ও সংসারের বাড়তি আয় বাড়াতে কুমড়ো বড়ি তৈরি করে নিজেদের পরিবারের অর্থের যোগান বৃদ্ধি করছেন। শীত মৌসুমে তারা প্রতি মাসে দেশের অন্যান্য জেলায় লক্ষ লক্ষ টাকার কুমড়ো বড়ি বিক্রি করে থাকেন। জানা যায়, ফুলতলার কুমড়ো বড়ি তৈরী ও বিক্রি শুরু হয়েছে আদিকাল থেকে। সাংসারিক কাজের ফাঁকে গৃহবধূরাই প্রধান কারিগর। কুমড়ো বড়ি তৈরী ও বিক্রি করে অনেকেই সংসারের বাড়তি আয় করে থাকেন। মাশকালাই ও খেসারি ডাল থেকে তৈরি করা এই সুস্বাদু খাবার শুধু শীতের সময়ই তৈরি এবং বিক্রি হয়ে থাকে। কুমড়ো বড়ি পল্লী নামে খ্যাত ফুলতলা উপজেলার কুন্ডুপাড়া গ্রাম। এই পল্লীর নারী-পুরুষরা কুমড়ো বড়ি তৈরি করে গ্রামীণ অর্থনীতি বদলে দিয়েছে। এছাড়া নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এই পল্লীটি। এখানকার বেশির ভাগ নারীরা এখন বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করছেন কুমড়ো বড়ি। কুমড়ো বড়ির কারিগররা জানান, মাষকলাইয়ের ডাল দিয়ে গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরি সুস্বাদু কুমড়ো বড়ি খুলনার চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও বিক্রি করা হচ্ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পাইকাররা প্রতিদিন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এই পল্লীর কুমড়ো বড়ি। কুমড়ো বড়ি তৈরির উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। এজন্য শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে কুমড়ো বড়ি তৈরির ব্যস্ততাও বেড়ে যায় এই পল্লীতে। তবে আশ্বিন মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত এই লাভজনক কুমড়ো বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়।
প্রতি বছরের মতো এবারও শীতের আগমনে ব্যস্ত সময় পার করছেন কুমড়ো বড়ি তৈরিতে। গৃহিণীরা বাড়ির ছাদে একত্রে দল বেঁধে, আবার কেউ কেউ মাটিতে মাদুর পেতে বড়ি তৈরির কাজ করছেন। এ গ্রামের অনেকের বাড়িতে হাতে ও মেশিনের মাধ্যমে এ কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজে লিপ্ত রয়েছেন। এ কাজে কারিগর হিসাবে এলাকার অসহায় নারী-পুরুষেরাও কাজ করে আয়-রোজগারের সুবিধা পাচ্ছেন। এখানকার প্রতিটি বাড়িতে বাণিজ্যিকভাবে কুমড়ো বড়ি তৈরি করা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এক সময় পরিবারে বাড়তি আয়ের জোগান দিতে এ খাবার তৈরি করা হতো। কিন্তু এখন বাণিজ্যিকভাবে এ সুস্বাদু খাবার তৈরি হচ্ছে। সকাল থেকে বাড়ির উঠানসহ বিভিন্ন খোলা জায়গায় চলে কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজ। বাড়ির গৃহিণী থেকে শুরু করে পুরুষ এবং ছোট-বড় ও বয়স্ক সবাই মিলে কুমড়ো বড়ি তৈরি করেন।
কুন্ডুপাড়া গ্রামের অরথি বিশ^াস জানান, গত বছর মাসকালাই ডাল প্রতি কেজি ১৩৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। তবে এ বছর এ ডাল ১৫০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। গত বছর সাধারণ মানের কুমড়ো বড়ি প্রতি কেজি ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা এবং ভালো মানের কুমড়োবড়ি ৩৫০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু এ বছর সাধারণ মানের কুমড়ো বড়ি প্রতি কেজি ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা এবং ভালো মানের বড়ি ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। উপজেলার ছাতিয়ানী গ্রামের গৃহবধূ কল্পনা জানান, ১৭ বছর ধরে কুমড়ো বড়ি তৈরি করছেন তিনি। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত চলে তাদের কর্মযষ্ণ। প্রথমে মাসকলাই রৌদ্রে শুকিয়ে যাতায় ভেঙ্গে পরিস্কার করে বা না ভেঙ্গে পানিতে ভিজিয়ে রেখে খোসা ছাড়িয়ে নেন। প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা মাসকলাই পানিতে ভেজাতে হয়। তারপর ঢেকি বা মেশিনে কুমড়ো বড়ির মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর দুইটির মিশ্রণে কুমড়ো বড়ির উপকরণ তৈরি করা হয়। মাঠ, বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদ বা খোলা জায়গায় ভোর থেকে বড়ি বসানো শুরু করা হয়। পাতলা কাপড়ে সারি সারি বড়ি বসানো হয়। কুমড়ো বড়ি বসানোর পর কমপক্ষে তিন দিন একটানা রৌদ্রে শুকানো হয়। সূর্যের আলো কম হলে ৩-৪ দিন পর্যন্ত শুকাতে সময় লেগে যায়। শুকানোর পর কাপড় থেকে বড়ি উঠিয়ে পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। বড়িকে শক্ত করার জন্য এর সঙ্গে অল্প পরিমানে আতপ চালের আটা মিশানো হয়।
ওই গ্রামের দিপংকার জানান, শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা কুমড়ো বড়ি তৈরি করি। এটা আমাদের বাপ-দাদার পেশা। বাপ-দাদার আমলে সবকিছুর দাম কম ছিল। এখন মাশকালাইসহ চাল, ডালের দাম কয়েকগুন বেড়ে গেছে। তিনি আরো জানান, চাহিদা ভালো থাকায় কুমড়ো বড়ি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা হচ্ছে। নারায়নগজ্ঞ থেকে কুমড়ো বড়ি নিতে আসা পাইকারী ব্যবাসায়ী আফছার মৃধা জানান, তার এলাকায় চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছর তিনি এখান থেকে কুমড়ো বড়ি কিনে নিয়ে যান। এছাড়াও এই গ্রামের কুমড়ো বড়ির গুনগত মান ভালো হওয়ায় দেশের অন্যান্য জেলাতেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফুলতলার তৈরী কুমড়ো বড়ির স্বাদ ভালো। কুমড়ো বড়ি তৈরি করে বর্তমানে এই গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের জীবনমান পাল্টে গেছে। পরিবর্তন হয়েছে তাদের ভাগ্যের। এতে করে তারা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছেন। এসব নারী-পুরুষরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।