খুলনায় কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে আসা নূর আজিম ও তার বাহিনীর এখন প্রকাশ্যে!
# কিশোর গ্যাং এর বিরুদ্ধে পুলিশের বিশেষ অভিযান শুরু #
কামরুল হোসেন মনি : ২০১৭ সালের দিকে খুলনায় কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে আসা নুর আজিম এখন নগরীতে প্রকাশ্যে বিলাসবহুল গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাথে রয়েছে মটরসাইকেল বহর তার বাহিনীর সদস্য মাছুদ, মামুন, ফয়সাল, মিরাজ, সালাউদ্দিনসহ প্রায় ২০-২৫ জন। এই বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে গত ৬ বছরে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি রয়েছে হত্যা মামলা। এছাড়া হত্যা, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, সুন্দরবনের কাঠ পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িত এই বাহিনীর সদস্যরা। সম্প্রতি এই বাহিনীর সদস্যরা এক ব্যবসায়ীর কাছে মোটা অংকের চাঁদাও দাবি করেছেন। কিন্তু এই নুর আজিমের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। খুলনায় একাধিক গোয়েন্দার সূত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পর খুলনায় নতুন পুলিশ কমিশনারের কাছে খুলনাবাসীর প্রত্যাশা নূর আজিম বাহিনীসহ অন্য সকল সন্ত্রাসীদের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।
একাধিক গোয়েন্দাদের সূত্র মতে, গত ৬ বছরে কিশোর গ্যাং আজিম বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে খুলনা থানায় হত্যা মামলা দুটি, মাদক মামলা ১০টি, হত্যাচেষ্টা মামলা ১৭টি, দ্রুত বিচার আইনে একটি, মানব পাচার একটি, নারী ও শিশু নির্যাতন একটি, রূপসা থানায় একটি, অস্ত্র আইন একটি ও একটি ডাকাতি মামলা। শুধু খুলনা শহরে নয়, ভাড়াটে হিসেবে বাইরে গিয়ে মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায় আজিম বাহিনী। বাগেরহাটের রামপাল থানায় মাদক মামলা রয়েছে আজিম বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে উপ-পুলিশ কমিশনার শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, নগরীতে কিশোর গ্যাং এর বিরুদ্ধে আমাদের পুলিশের বিশেষ অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে। যে সব এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি সেই সব এলাকায় পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, নূর আজিমের বাড়ি খুলনা মহানগরীর টুটপাড়ার জাকারিয়া এলাকায়। নূর আজিমের বাবা শানু মুহুরি একজন আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ২০১৭ সালের দিকে কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে আজিম। নগরীর লবণচরা এলাকায় ওই কিশোর গ্যাং বহু অপরাধে জড়িত ছিল। এ নিয়ে ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মহানগর আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ছত্রছায়ার কারণে ওই সময় আজিমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে দিনে দিনে আরও বেপরোয়া ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ভয়ে মামলাও করতে যাননি।
একাধিক সূত্রে মতে, কয়েক বছর ধরে খুলনা মহানগরীর পাড়া-মহল্লা দাপিয়ে বেড়ানো এই গ্যাংয়ের মূলহোতার নাম নূর আজিম। শুধু খুলনা মহানগরীই নয়, জেলার বিস্তীর্ণ জনপদেই আধিপত্য ‘নূর আজিম বাহিনী’র। এমনকি সুন্দরবনের একটি অংশেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। বাড়িঘর নির্মাণে চাঁদা, উন্নয়ন কাজে বখরা, ছিনতাই, মাদক, কাঠ পাচার, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এখন এই বাহিনীর হাতে। প্রায় প্রতিদিনই শহরের কোথাও না কোথাও ঘটছে হামলা-নির্যাতনের ঘটনা। আজিম বাহিনীর বর্তমান সদস্য শতাধিক। এর মধ্যে বেশি আলোচনায় রয়েছে আজিমের বন্ধু বিসমিল্লাহ, ভাই সাগর, বাহিনীর সদস্য বিকুল, মাসুদ, মিরাজ, নাহিদ, ফয়সাল. তৌহিদসহ কয়েকজন। মহানগর এবং আশপাশের সব অপকর্মেই এদের তৎপর দেখা যায়। বিভিন্ন মামলার নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রায় সবগুলোতেই রয়েছে এসব সহযোগীর নাম। আজিম বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে রয়েছে তার বন্ধু বিসমিল্লাহ।
এলাকাবাসী জানায়, নগরজুড়ে নিজের আধিপত্য বিস্তর করতেই ওই কাউন্সিলর তৈরি করেন কিশোর গ্যাং, যার নেতৃত্বে ছিলেন নূর আজিম। ছোট ছোট অপরাধ দিয়ে শুরু হলেও এখন কথায় কথায় খুন-খারাবিতে জড়িয়ে পড়ছে আজিম বাহিনী। খুলনাজুড়ে সক্রিয় থাকলেও নগরীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আজিম বাহিনীর। বিশেষ করে নগরীর টুটপাড়া, চানমারী, লবণচরা, বান্দা, আশি বিঘা, নিজ খামার, রিয়া বাজার ও সোনাডাঙ্গা এলাকায় আজিমের মুখের কথাই আইন। এই এলাকাগুলো সরাসরি দেখভাল করে নূর আজিমের ছোট ভাই সাগর ও বাহিনীর সদস্য নাহিদ। এই বাহিনীর অস্ত্র দেখাশোনার দায়িত্বও সাগরের ওপর। সাগরের সহযোগী হিসেবে কাজ করে নাহিদ। ২০২২ সালে ২৯ অক্টোবর বিদেশি অস্ত্র, গুলিসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল নাহিদ। আজিম গ্রুপের প্রধান শুটার হিসেবে কাজ করে বিকুল। তার নামে খুলনার বিভিন্ন থানায় অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। বিকুল ছাড়াও এই বাহিনীতে শুটার হিসেবে আছে মাসুদ ও মিরাজ। দুজনের নামেই একাধিক হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে। গত ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর রাতে রাতে লবণচরা থানা এলাকায় ঘের ব্যবসায়ী সিহাব ও শাকিলকে প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের ভর্তি করা হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে। ওই সময়ে হাসপাতালে শাকিল সাংবাদিকদের বলেছিলেন ‘রাতে হঠাৎ দু-তিনজন এসে সরাসরি গুলি করতে শুরু করে। তারা খুব কাছ থেকে কোমর ও পায়ে গুলি করে। অস্ত্রধারীদের মধ্যে কালা লাভলু নামে পরিচিত একজনকে চিনতে পারি। সে আজিম বাহিনীর সদস্য এবং পেশাদার খুনি।’ এর আগে ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর সন্ত্রাসীরা খেলার মাঠে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায় সিয়ামকে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় তার। সিয়ামকে তাদের বাহিনীতে যোগ দিতে বলেছিল নূর আজিমের সহযোগীরা। কিন্তু সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারণে ওই বাহিনীর সদস্যরা সিয়ামকে হত্যা করে। ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পরদিন খুলনার কৈয়া বাজার এলাকা থেকে সিয়ামের সহপাঠী রায়হান রাব্বি, আবু সাইদ ও ছোট রনিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেসময় এরা সবাই ছিল নূর আজিমের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।