অনিরাপদ ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে খুলনায় আবাসিক হোটেলগুলো
# এসব হোটেলে ধর্ষণ, মাদক সেবন, দেহব্যবসা থেকে শুরু করে খুন-খারাবিসহ এহেন কোন কাজ অপরাধ নেই যা সংগঠিত হচ্ছে না #
কামরুল হোসেন মনি ঃ নিয়ম-নীতি মানছে না খুলনার অধিকাংশই আবাসিক হোটেলগুলো। যার কারণে খুলনায় অনিরাপদ ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে আবাসিক হোটেলগুলো। এসব হোটেলে ধর্ষণ, মাদক সেবন, দেহব্যবসা থেকে শুরু করে খুন-খারাবিসহ এহেন কোন কাজ অপরাধ নেই, যা সংগঠিত হচ্ছে না। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ব বিদ্যালয় পড়–য়া তরুণ-তরুণীরাও এখন পার্ক ছেড়ে উঠছে আবাসিক হোটেলে। অনৈতিক কাজের অভিযোগে আটকও হচ্ছে পুলিশের হাতে। আর এসবের সুযোগও করে দিচ্ছে হোটেল কর্তৃপক্ষই। যার বিনিময়ে ঘন্টা চুক্তিতে উচ্চমুল্য পাচ্ছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। এ জন্য এখন আর নির্দেশনা থাকলেও আবাসিক হোটেলগুলোতে আগত বোর্ডারদের তথ্যও নথিভুক্ত করা হচ্ছে না রেজিস্ট্রারে।
গত ৩০ অক্টোবরে খুলনা থানা পুলিশের অভিযানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার অপরাধে ৩২ জন নারী-পুরুষকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিলেন। নগরীর হোটেল সুন্দরবন, আরাফাত, জেএইচসহ ৭টি আবাসিক হোটেলে এ অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করেন। আটকের মধ্যে ২৫ জন নারী ও ৭ জন পুরুষ ছিলো। ২০২২ সালে অক্টোবর মাসে আবাসিক হোটেল রিদওয়ানে এক ছেলেকে জিম্মি ও নির্যাতন করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে খুলনা থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে আটক করেছিলেন। ওই সময় পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, জনৈক এক যুবক ওই হোটের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে একটি নারী কক্ষে নিয়ে যায়। তবে রুমে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হয় চার থেকে পাঁচ জনের একটি চক্র দল। ওই ছেলেকে এখানে নারীর সঙ্গে কি কি করছিস সব ভিডিও আছে। এই বলে তারা আমাকে বেদম মারপিট করে। এক পর্যায়ে তাদের দাবিকৃত ৬০ হাজার টাকা দিলে ছেড়ে দেয়। পুনরায় ওই চক্রটি চাঁদা দাবি করে। শেষে উপায় না পেয়ে ছেলেটি খুলনা সদর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে খুলনায় একটি আবাসিক হোটেলে গিয়ে নারী (২৮) ধর্ষণের অভিযোগে ডিবির সাব ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলমকে (৪৪) গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। ভুক্তভোগীর দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেফতার করেছিলেন। ভুক্তভোগীর দায়েরকৃত মামলায় জানা যায়, গত ৭ ডিসেম্বর বিকালে বাগেরহাটের মোংলা থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুকন্যা ও ভাগনেকে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য খুলনায় আসেন ওই নারী (২৮)। তবে ডাক্তারের সিরিয়াল না পাওয়ায় রাতে থাকার জন্য সুন্দরবন আবাসিক হোটেলে তৃতীয়তলার ৩১৩ নম্বর রুম মেয়েকে নিয়ে ওই নারী উঠেন। আর ভাগনে আরেক রুমে থাকেন। রাত সোয়া ২টার দিকে হোটেলবয়কে নিয়ে পুলিশ পরিচয়ে রুমে প্রবেশ করে জাহাঙ্গীর। ওই নারীর সঙ্গে থাকা মেয়েটি কার জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। তিনি নিজের মেয়ে পরিচয় দিলে জাহাঙ্গীর বিশ্বাস করতে চায়নি। এরপর হুমকি-ধমকি দিয়ে হোটেলবয়কে রুম থেকে তাড়িয়ে দেন তিনি। রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে ভয়ভীতি দিয়ে ওই নারীকে ধর্ষণ করে জাহাঙ্গীর। ২০১৮ সালের জুন মাসে নগরীর পিকচ্যার প্যালেস মোড়স্থ হোটেল আজমল প্লাজার ৫ম তলার ৫০২ নম্বর কক্ষ থেকে দুর্গন্ধ আসতে থাকায় হোটেল কর্মচারীরা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময়ে ওই ঘরের বক্স খাটের নিচে হাত-পা বাধা যুবকের লাশের সন্ধান পায়। এর আগে এক তরুনীকে নিয়ে ্ওই য্বুক হোটেলে রুম ভাড়া নেয়। তবে ওই সময় তরুনীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তৎকালীন খুলনা থানা সেকেন্ড অফিসার এসআই টিপু সুলতান জানিয়েছিলেন হোটেল রেজিস্ট্রারে তাদের কোন নাম ঠিকানা নেই। এ কারণে হোটেলের মালিকের ছেলেসহ ৪ জনকে আটক করেছিলেন। এছাড়া ২০১১ সালে জানুয়ারি মাসে নগরীতে রাজমুকুট আবাসিক হোটেলের কক্ষ থেকে হাসিনা বেগম (৩৫) নামে এক মহিলার লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ওই সময়ে হোটেল ম্যানেজারের ভাষ্য অনুযায়ী জনৈক রাজু আহমেদ ( ৩৮) ওই মহিলাকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে হোটেলের ৫০৫ নং ক ভাড়া নেন। দুপুরের দিকে হোটেল বয় পরিস্কার করতে গিয়ে কক্ষ তালাবদ্ধ দেখতে পায়। পরে বিকল্প চাবি দিয়ে তালা খুলে মহিলার লাশ দেখে পুলিশে খবর দেয়। যৌন লালসা মেটাতে ওই মহিলাকে হোটেলে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কোনো নিয়ম-কানুন ছাড়াই স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের ঘণ্টাপ্রতি মূল্য ধরে হোটেল কক্ষ ভাড়া দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এতে কিছু অসাধু পুলিশকে ম্যানেজ করে এ ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে কিছু অসাধু হোটেল ব্যবসায়ীরা। এভাবে শিক্ষার্থী ও গৃহবধূদেরও আবাসিক হোটেলে তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই রুম পাওয়ার বিষয়টি সহজ হওয়ার সাথে সাথে যেমন অনৈতিক কাজ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে, তেমনি এর প্রভাবে খুন-খারাবিও বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ এমনটাই আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এ রকম অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ বলছে, ২০০৮ সালের মার্চ মাস থেকে আবাসিক হোটেলের বোর্ডারদের নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও মোবাইল ফোন নম্বর উল্লেখ করতে নির্দেশনা দেয়া আছে। অপরাধ সংঘটনের পর পালিয়ে গেলে অপরাধীকে শনাক্ত করতে সিসিটিভি ক্যামেরা ও বোর্ডারদের ছবিও তুলে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ। মোবাইল ফোন নম্বর সঠিক কি-না তা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করে নিতে বলা হয়। পূরণ করা তথ্য ফরমের ফটোকপি প্রতিদিন স্থানীয় থানায় পাঠানোর নির্দেশও দেয়া হয়। কিন্তু ওই নির্দেশনা মানছেন না হোটেল মালিকরা। তবে হোটেল মালিকরা বলছেন, নিয়মিত চাঁদা দিয়েই হোটেল ব্যবসা চালাতে হয়। তাই হোটেল মালিকরা বাড়তি ঝামেলায় যেতে চান না। চাঁদাসহ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই কোথাও কোথাও হয়তো অনৈতিক কাজের সুযোগ দিচ্ছে বলেও অনুমান করছেন হোটেল মালিকদের কেউ কেউ।
সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানায়, হোটেল-মোটেলগুলোতে খুন, অসামাজিক কার্যকলাপ, প্রতারণার মাধ্যমে নগ্ন ছবি ধারণ, চাঁদাবাজি, মাদক কেনাবেচা, সেবন ও জুয়ার আসরসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। রাতভর চলে সুন্দরী নারী বাণিজ্যে। নিম্ন শ্রেণীর হোটেল থেকে উচ্চ দামের হোটেল-কটেজগুলোতে নানা দরদামে নিশি রমনীদের সঙ্গে মিলছে রাত কাটানোর সুযোগ। পাশাপাশি হোটেল কক্ষে গাঁজা, ফেন্সিডিল ও ইয়াবা সেবন করা হচ্ছে। এ নিয়ে পুলিশের কাছে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও কম হচ্ছে অভিযান। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাইট হাউজের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে ২৪শে জুন পর্যন্ত নগরীর ৩ থানাধীন এলাকায় যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ১ হাজার ১২২ জন। যার মধ্যে হোটেলে যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ৭৫ জন, আবাসিকে রয়েছে ৪৮৬ জন ও ভাসমান যৌনকর্মী রয়েছে ৫৬১ জন। এসব যৌনকর্মীকে লাইট হাউজের মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। এর আগে ২০১৮ সালে যৌনকর্মী ছিল ১ হাজার ৪২ জন এবং ২০১৭ সালে ছিল ৮৫০ জন। এর আগে ২০১৬ সালে ছিল ৭১৯ জন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাইট হাউজ খুলনা সদর, সোনাডাঙ্গা ও খালিশপুর থানার আংশিক এলাকায় ও পূর্ব রূপসার আংশিক এলাকায় যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের সেবা প্রদান করে থাকে। সূত্রমতে, নগরীর বাইরে খুলনায় যৌনকর্মীর সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি বলে জানা যায়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দূর্জয় নারী সংঘের সর্বশেষ ২০০৪ সালের হিসেব অনুযায়ী নগরীতে পেশাদার যৌনকর্মী ছিল ৩ হাজার ৫০০ জন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওয়ার্ল্ড ভিশনের সর্বশেষ ২০০৫ সালের তথ্য অনুযায়ী নগরীতে অপেশাদার যৌনকর্মী রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ জন। এছাড়া রয়েছে ভ্রাম্যমান যৌনকর্মী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করে তারা চলে যায়। শহর সংলগ্ন বিভিন্ন উপজেলা এবং বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের অভাবী মেয়েরা যৌনকাজে লিপ্ত হচ্ছে। তারা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় শহরে আসছে এবং কাজ শেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। খুলনার উপ-পুলিশ কমিশনার ( দক্ষিণ) মনিরুজ্জামান মিঠু সাংবাদিকদের বলেন, নগরীতে বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে এ অভিযান চালানো হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি হোটেলে অভিযান পরিচালনা করে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত হওয়ার অপরাধে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। এখন থেকে তাদের এধরনের নিয়মিত অভিযান চলমান থাকবে।