‘যশোরের যশ খেঁজুরের রস’ এই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জেলা যশোহর
মোঃ আব্বাস উদ্দীন, মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধিঃ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত বৃহত্তর যশোরের (বর্তমান যশোর জেলা, মাগুরা জেলা, ঝিনাইদহ জেলা ও নড়াইল জেলা) বিশেষ ঐতিহ্যের গৌরব ও প্রতীক হলো খেঁজুরের রস ও গুড়। যেটা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য যশোহর জেলার খেঁজুর গাছের। যশোহর এক সময় খেঁজুরের গুড়ের জন্য বিখ্যাত ছিলো। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ী যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে। তাই তো মধু কবির নামানুসারে খেঁজুর গাছকে মধুবৃক্ষ বলেও অনেকে অভিহিত করেছেন। তাছাড়া পুঁথি কথা ‘যশোরের যশ খেজুরের রস’ শুনতে বেশ মধুর লাগে। শীতের শুরুতে যশোরের মানুষ খেঁজুর রসের গন্ধে হয় মাতোয়ারা। গাছিরা খেঁজুরের রস সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই আগের মতো যশোরের খেঁজুর গাছের প্রাচুর্যতা এখন আর নেই! ইটভাটার জ¦ালানীতে খেঁজুর গাছের লগ দাহ্য করার প্রতিযোগিতা এবং যথেচ্ছা বসতি গড়ে উঠায় নির্বিচারে খেঁজুর গাছ নিধন হয়েছে সীমাহীন। ফলে খেঁজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বহু মানুষের বাড়ীতে শীতের খেঁজুরের রস-গুড়ের আয়োজন এখন আর নেই! মাঠে-প্রান্তরে,রাস্তার ধারে, জমির আইলে,পুকুর পাড়ে ও গ্রামের মধ্যে যত্রতত্র যে সব ঝোপ-ঝাড়ের ন্যায় খেঁজুর গাছ দেখা যেত, সে সব অনেক কমে গেছে। যা কিছু আছে তার কদর এখন আর নেই। কারণ খেঁজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গাছিরা পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছে। ফলে গাছির অভাবে বহু গাছ এখন তোলা হয় না! কিছু পুরনো গাছি বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য খেঁজুরের রস-গুড়ের মল বজায় রেখেছে। যশোরের মণিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের গাছিরা তাই শীতের শুরুতে গাছ তোলার কাজে এখন ব্যস্ত হয়ে ইঠেছে। গত রবিবার সকালে মণিরামপুর উপজেলার শ্যামকূড় ইউনিয়নের ঘুঘুরাইল চাতাল বাজারের পাশে রাস্তার ধারে এক গাছিকে খেঁজুর গাছ তুলতে দেখা যায়। নিকটে যেয়ে পরিচয় নিয়ে জানা যায়, মোসলেম উদ্দীন গাজী (৬২)নামের ওই গাছির বাড়ি পাশ^বর্ত্তী কাশিপুর গ্রামে। প্রতিটি খেঁজুর গাছ তোলা-চাছা বাবদ ১০০ টাকার চুক্তিতে তিনি গাছ তুলছেন। তোলা-চাছার পর খিলানোর (ঠিলে/ভাড় পাতার) সময় নিবেন আরও ৫০ টাকা। তাকে দিয়ে শীতের মৌসুমে কোন মালিক যদি গাছ কাটান তবে ওই মালিককে দিতে হবে গাছ প্রতি প্রতিদিনের মজুরি বাবদ ৪০ টাকা। এ ছাড়া আরও দুইজন গাছির সাথে এসময় কথা হয়। ঘুঘুরাইল গ্রামের নিছার দফাদারের ছেলে সুকচান দফাদার জানান, তার নিজস্ব ২০টি খেঁজুর গাছ তিনি নিজেই কাটের-পাড়েন। আর প্রতিবেশীদের কিছু গাছ বর্গা নিয়ে কেটে থাকেন। তিনি শুধুমাত্র জিড়েন রস (পরিস্কার রস) অর্ধেক ভাগা দেওয়ার শর্তে প্রতিবছর ৪০/৫০ টি খেঁজুর গাছ মালিকদের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে কেটে থাকেন বলে জানান। এলাকায় গাছির মেলা অভাব তাই শীতের মৌসুমে তার মতো অনেকেই খেঁজুর গাছ কাটার কাজে মজুরির বিনিময়ে আবার কেউ কেউ বর্গা নিয়ে খেঁজুর গাছ কেটে থাকেন। পাশ^বর্ত্তী কাশিপুর গ্রামের পুরনো গাছি আকাম সরদার ও মোকাম সরদার শীতের মৌসুমে খেঁজুর গাছ কাটেন ও খেঁজুরের রস-গুড়ের মল করে ভাল রোজগার করে থাকেন বলে জানালেন একাকার প্রবীন গাছি সামাদ গোল্দার। তিনি আরও জানান, এক সময় গ্রামের প্রতি বাড়ীর বানশালাতে (রস জ¦ালিয়ে গুড়-পাটালি বানানোর স্থান) রস-গুড়ের বেশ রমরমা আয়োজন থাকতো। গ্রামের বধুরা সেই কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে মধ্য রাত পর্যন্ত বানশালাতে রস জ¦ালানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করতো। এ সব এখন নেই বললেই চলে। তবে খেঁজুরের রসের কদর এখন বেশ হয়েছে। এক ভাড় কাঁচা রস বিক্রি হয় দেড়’শ থেকে দু’শ টাকা হারে। আর রসের পিঠা খাওয়ার তাতরসের (জ¦ালানো রস) দাম আরও বেশি। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে ১০/১২ ভাড়/ঠিলে কাঁচা রস জ¦ালিয়ে এক ভাড় গুড় হয়। যার শুষ্ক ওজন ১০ কেজি । বাজারে যার বিক্রয় মূল্য ১৫’শ থেকে দুই হাজার টাকা। অন্যদিকে খেঁজুরের পাটালির দাম আরও বেশি। এক কেজি পাটালির মূল্য আড়াই’শ থেকে তিন’শ টাকা। দাম বেশি হওয়ায় অনেক অসাধু গাছি ও গুড় বিক্রেতা গুড়ের সাথে চিনি ও অন্য কোন সস্তা মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে এটি ভেজাল হিসেবে বাজারে বিক্রি করছে। ফলে যশোরের ঐতিহ্য খেঁজুরের রস-গুড়ের সেই ঐতিহ্য এখন বিলীন হতে চলেছে। উপজেলার শ্যামকূড় ইউনিয়নের হালসা গ্রামের রওশন আলী সরদারের মেঝ ছেলে কৃষক হাসান আলী সরদার জানান, তার বাবা প্রায় ২৫০-৩০০টি খেঁজুর গাছের মল করেছেন। প্রত্যহ ৫০/৬০ ভাড় রস হতো। এগুলো জ¦ালিয়ে ৫/৬ ভাড় করে গুড় হয়েছে। আমাদের বানশালাতে সারা শীতকালে রস-গুড়ের মেলা বসতো। কত মানুষ আমাদের রস-গুড় খেয়েছে। গ্রামে ইটভাটা হওয়ার পর একে একে সব খেঁজুর গাছে উজাড় হয়ে গেছে। এখনও বেশ গাছ আছে কিন্তু সেগুলি কাটার লোক নেই!
তবুও শীতকাল এলে অযতেœ অবহেলায় পড়ে থাকা খেঁজুর গাছের কদর বেড়ে উঠে। গ্রামের মানুষেরা চিরচেনা খেঁজুর গাছের মিষ্টি সুমধুর রস আরোহন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। কারণ খেঁজুরের রস জ্বালিয়ে পাতলা- ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালি তৈরী করা হয়। খেঁজুরের গুড় থেকে এক সময় বাদামী চিনিও তৈরী করা হতো। যার সাধ ও ঘ্রান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাদের তৃপ্তিতে বাদামী চিনির জুড়ি নেই। এখন অবশ্যই সেই চিনির কথা নতুন প্রজন্মের কাছে রূপ কথার গল্পের মত মনে হয়। খেঁজুর গাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যত বেশী শীত পড়বে তত বেশী মিষ্টি রস দেবে। পুরোপুরি মৌসুমে চলবে রস, গুড়, পিঠা-পুলি, পায়েস খাওয়ার পালা। আর কিছুদিন পর নতুন গুড়ের মিষ্টি গন্ধে ধীরে ধীরে আমোদিত হয়ে উঠবে গ্রাম বাংলা। দিন শেষে গ্রামীণ সন্ধ্যা কালিন পরিবেশটা বড়ই আনন্দের। খেঁজুর রসের কারণে গ্রামীণ পরিবেশটা মধুর হয়ে উঠে। মন ভরে যায় সন্ধ্যার খেঁজুরের রসে। এখন সবে মাত্র শুরু হয়েছে রস সংগ্রহ করার পালা। আর কিছুদিন পর পুরোদমে শুরু হবে খেজুর গাছের রস খাওয়ার ধুম। শহর থেকে দলে দলে ছুটে আসবে গ্রামে। এই সময় খেজুর গাছ থেকে রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণ চাঞ্চল্য বাড়বে। যদিও আগের মত সেই রমরমা অবস্থা আর নেই! তাইতো যশোরের খেঁজুরের রস-গুড়ের ঐতিহ্য বজায় রাখতে সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণের দাবী উঠেছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মণিরামপুর উপজেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন, আমাদের কৃষ্টি-সভ্যতার ধারক ও বাহক খেঁজুর গাছকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সরকারিভাবে নতুন করে খেঁজুর লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উপজেলা কৃষি অফিসার ঋতুরাজ সরকার বলেন, যশোরের ঐতিহ্য খেঁজুর গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ২০০৯ সাল থেকে এ অঞ্চলে খেঁজুর গাছ রোপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবছর রাস্তার ধারে ও পতিত জমিতে খেঁজুরের বীজ/চারা রোপন করা হয়। গাছ কাটার জন্য গাছিদের প্রশিক্ষণ ও গাছে উঠার উপকরণ সহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খেঁজুর গাছ থেকে রস আরোহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে গাছির সংকট নিরসন হবে এবং শ্রমজীবি যুবকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত হলে বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং যশোর অঞ্চলের খেুঁজুরের গুড়-রসের ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে।